শাহেদের প্রতারনার জাল সিলেটে : নিঃস্ব অনেক ব্যবসায়ী

আমিনুল ইসলাম রোকন;
  • প্রকাশিত: ১৬ জুলাই ২০২০, ১:০৫ অপরাহ্ণ | আপডেট: ৪ বছর আগে

শান্তির জনপদ সিলেটকে টার্গেট করেছিলেন প্রতারক শাহেদ। ভয়াবহ প্রতারনার জাল পেতেছিলেন সিলেটে। এই জালে আটকা পড়ে নিঃস্ব এখন সিলেটের অনেক ব্যবসায়ী।

বিয়ের সুবাদে সিলেটের সাথে ঘনিষ্ঠতা শাহেদের। নগরের দক্ষিণ সুরমা এলাকায় দ্বিতীয় বিয়ে তার। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় খোদ শাশুড়ির সাথেই প্রতারনা করে বসেন। এক সপ্তাহের কথা বলে শাশুড়ির ব্যাংক একাউন্ট থেকেই হাতিয়ে নেন কয়েক লাখ টাকা। প্রতারনা এই জাল ছড়িয়ে দেন পুরো সিলেটেও। দেশের সাদা সোনা বলে খ্যাত পাথরকেই টার্গেট করেন তিনি। সফলও হন। সিলেটের পাথর পুরো দেশের নির্মাণের বড় পন্য। সিলেট থেকে তাই পাথর নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন শাহেদ। কোটি কোটি টাকার পাথর নেবেন, বড় ওয়ার্ক ওর্ডার পাইয়ে দেবেন -এমন লোভনীয় অফার নিয়ে সিলেটের পাথর ব্যবসায়ীদের কাছে ভিড়েন তিনি। সিলেট আসলে ভিআইপি ভেসে চলতেন এই প্রতারক। সঙ্গে থাকতেন চারজন সশস্ত্র দেহরক্ষী। নানা প্রভাবশালী পরিচয় দিতেন। নিজেকে জাহির করতেন সরকারের কাছের লোক হিসেবেই। সরকারি বড় বড় সব কাজ তার হাতের মুঠোয়- এমন কথা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সিলেটের পাথর রাজ্যে।অনেক ব্যবসায়ী তাই সহজেই ফাদে পড়েন প্রতারক শাহেদের।
হাজী শামসুল মাওলা, সিলেটের জাফলং পাথর কোয়ারীর একজন মাঝারি সারীর পাথর ব্যবসায়ী। রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান শাহেদ এর প্রতারনায় সর্বস্বান্ত হয়ে এখন ফেরারি জীবন যাপন করছেন। তার কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকার পাথর নিয়ে পুরো টাকাটাই মেরে দিয়েছে শাহেদ। ধার দেনা করে পাথর সরবরাহ করে বিল না পেয়ে শামসুল মাওলার জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। পাওনাদারদের চাপে এখন তিনি বাড়িছাড়া। জীবনে দুঃস্বপ্নের মতো নেমে আসা হাজী শামসুল মওলার এমন করুন কাহিনীই এখন সিলেটের টপ অব দি টাউন।
হাজী শামসুল জানান, গতবছর হঠাৎই একদিন ঢাকার এক ভদ্রলোক তার কাছ থেকে এক গাড়ি পাথর কেনেন। যাথারীতি নগদে বিলও পরিশোধ করেন সেই ব্যক্তি। যাওয়ার সময় তিনি শামসুল মাওলাকে ঢাকায় গিয়ে তার বস এর সাথে দেখা করার প্রস্তাব দেন। ‘বস’ এর সাথে দেখা করলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য পাথর সরবরাহের বড় একটি কন্ট্রাক্ট পাবেন বলে জানান। শামসুল মাওলা সরল বিশ্বাসে ঢাকায় গিয়ে মো. শাহেদ নামের কথিত সেই ‘বস’ এর সাথে দেখা করেন। এসময় শাহেদ নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দিলে সহজেই বিশ্বাস করেন শামসুল মাওলা।
কারণ, রাজধানীতে আলীশান অফিস, আর তার কক্ষে টানানো রাষ্ট্রের সব ভিআইপিদের সঙ্গে তার ছবি দেখে এমন বিশ্বাস না করার কোন উপায়ই ছিলো না। কথাবার্তা শেষে ৩০ লাখ টাকার পাথর সরবরাহ করেন শামসুল মাওলা। এরপর আরেকদিন বিল আনতে ঢাকায় গেলে তাকে দশ লাখ টাকা করে ত্রিশ লাখ টাকার তিনটি চেক ধরিয়ে দেয় শাহেদ। খুশিমনে সিলেট ফেরেন শামসুল মাওলা। কিন্তু তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে পরদিন ব্যাংকে গিয়ে। দুটি চেকই ফান্ড স্বল্পতার কারণে ডিজঅনার্ড হয়। অন্য চেকটি তার নিজের একাউন্টেরই নয়। অর্থাৎ ভূঁয়া চেক।
বিষয়টি শাহেদকে ফোনে জানাতেই সুর পাল্টে ফেলে শাহেদ। শামসুল মাওলাকে উল্টো গালাগাল করে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। আচমকাই এমন প্রতারণায় দিশেহারা হয়ে পড়েন হাজী সাব খ্যাত ষাটোর্ধ এ ব্যবসায়ী। এরপর টাকার জন্য বহুবার ঢাকায় গিয়ে শাহেদের অফিসে ধর্না দেন তিনি, কিন্তু প্রতিবারই তাকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। এক পর্যায়ে ঢাকা উত্তরা পশ্চিম থানায় প্রতারনা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে শাহেদের বিরুদ্ধে একটি জিডি করেন শামসুল মাওলা। জিডির তদন্ত কর্মকর্তা শাহেদকে ফোন দিলে তাকে সে ‘তুই-তুকারি’ করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে, এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দিয়ে নানা হুমকি প্রদান করে। শামসুল মাওলা জানান, এসময় রীতিমত ভয় পেয়ে যান তদন্ত কর্মকর্তা এস আই মিজান । পরে শাহেদ তার অফিসে ডেকে পাঠায় শামসুল মাওলাকে।
প্রথমে ভয় লাগলেও টাকা পাওয়ার আশায় তিনি আবারও ছুটে যান শাহেদের অফিসে। কিন্তু সেখানে শাহেদের এক ড্রাইভার তাকে পরামর্শ দেয় প্রাণে বাঁচতে হলে এখান থেকে চলে যেতে। কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন শামসুল মাওলা। আবারও ছুটে যান উত্তরা থানায়। পুলিশের কাছে সহায়তা চান। কিন্তু, থানার তৎকালীন ওসি তাকে জানান, শাহেদ খুবই প্রভাবশালী লোক। তার বিরুদ্ধে জিডি করে কোন লাভ হবে না। বরং তাকে সিলেট ফিরে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেন ওসি। যথারীতি সিলেট ফিরে আসেন শামসুল মাওলা। আদালতে দুটি চেক ডিজঅনারের মামলা করেন শাহেদের বিরুদ্ধে । দিন, মাস, বছর যায়। কিন্তু মামলায় কোন প্রতিকার পান না তিনি। উল্টো শাহেদ তাকে ফোন দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয়।
এদিকে, বিশাল অংকের দেনাগ্রস্থ হয়ে পড়ায় শামসুল মাওলার জীবনে নেমে আসে করুন বিপর্যয়। পাওনাদাররা তাকে টাকা পরিশোধে চাপ দিতে থাকে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় শামসুল মাওলার। এমনকি পাওনাদারদের কোন সদুত্তর দিতে না পেরে একসময় বাড়ি ছেড়ে ফেরারি জীবন শুরু করেন তিনি। এসময়ে পাওনা টাকার জন্য বহু মানুষের সহযোগিতা চেয়েও ব্যর্থ হন বলে জানান।
রিজেন্ট কেলেংকারিতে বুধবার শাহেদ গ্রেপ্তার হয়েছে খবর পেয়ে র‍্যাব সদর দফতরে গিয়ে হাজির হন শামসুল মাওলা। মামলার কাগজপত্র দেখান র‍্যাব কর্মকর্তাদের। পাওনা টাকা ফিরে পেতে তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি