পাথর লুট: সৌন্দর্য হারাচ্ছে সিলেটের পর্যটন স্পট

মিঠু দাস জয়;
  • প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬:২০ অপরাহ্ণ | আপডেট: ১ সপ্তাহ আগে

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি সিলেট। সারা বছরই দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসেন সিলেটে। তবে, চলতি বছরের শুরুর দিক থেকেই সিলেটের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় তুলনামূলক কমতে থাকে পর্যটক। দফায় দফায় বন্যা, রাজনৈতিক সহিংসতার কারনে পর্যটন কেন্দ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যেও ধস নামে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন- ভাঙ্গা রাস্তাঘাট, পর্যটন স্পটগুলো থেকে পাথর চুরি, নিরাপত্তার অভাব, অতিরিক্ত ভাড়া, স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। সর্বোপরি সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলো মাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মাজারে হামলার ঘটনায় সিলেটে আসতে আস্থা হারিয়েছেন পর্যটকরা।

তবে, সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেছেন, অস্থিরতা অনেকটা কেটে গেছে-সিজন আসলে আবার মুখর হবে সিলেটের পর্যটন এলাকা।

পাহাড়, টিলা আর দিগন্ত বিস্তৃত চা-বাগান যেন সিলেটকে ঢেকে রেখেছে সবুজ চাঁদরে। হযরত শাহজালাল (রহ.) হযরত শাহপরাণ (রহ.)সহ ৩৬০ আউলিয়ার পূণ্যভূমি এবং সিলেটের গোলাপগঞ্জের ঢাকা দক্ষিণে শ্রী চৈতন্যের তীর্থস্থান সিলেটকে দিয়েছে আলাদা মর্যাদা। সিলেটে রয়েছে গ্যাস আর তেলের মত প্রাকৃতিক সম্পদ। এখানে জন্মেছেন মরমী কবি হাসন রাজা, রাধা রমন দত্ত, আরকুম শাহ, দূরবীন শাহ ও শাহ আব্দুল করিমের মত মরমী সাধকরা।

সিলেট নগর ও পাশ্ববর্তী বিমানবন্দর সড়কে দুপাশে রয়েছে সিলেটের প্রথম চা বাগান মালনীছড়া। বিমান থেকে নেমে সিলেটের প্রবেশমুখে এ চা বাগান পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এ ছাড়া লাক্কাতুড়া চা বাগান, কালাগুল, গুরজান, বাইশটিলা, খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের প্রাকৃতিক পরিবেশ পর্যটকদের বার বার টানে।

সীমান্তবর্তী পর্যটন উপজেলা গোয়ানঘাটে রয়েছে ৪ টি পর্যটন কেন্দ্র- জাফলং, রাতারগুল, পান্তুমাই ও বিছনাকান্দি। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষন বিছনাকান্দি। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে সাত পাহাড়ের মিলনমেলায় স্বচ্ছ পানি ও সাদা পাথরের লুনি নদীর সীমান্তে বিছানাকান্দি পর্যটন স্পট। একসময় এর স্বচ্ছ পানি-পাথরের মেলবন্ধনে পর্যটকদের প্রচুর টানত। সেই পাথরে এখন পাথর খেকুদের কাল থাবা।

দীর্ঘদিন ধরে পাথর লুট হলেও সরকার পতনের সুযোগে কয়েক দিনের মধ্যেই লুট করা হয়েছে কয়েক কোটি টাকার পাথর। পাথর লুট হওয়ায় আগের সৌন্দর্য হারিয়েছে বিছানাকান্দি পর্যটন স্পট।

স্থানীয়রা জানান, একসময় বিছনাকান্দি পর্যটন স্পটে দেশ ও বিদেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসতেন কিন্তু দিন দিন পর্যটন স্পটের সৌন্দর্য ম্লান হওয়ায় এখন আর আগের মতো পর্যটক আসে না। যাতায়াতে ভোগান্তি, অতিরিক্ত ভাড়ার কারনে বিছনাকান্দি পর্যটন স্পটে ঘুরতে আসতে চায় না ভ্রমণ প্রিয়াসুরা।

সিলেট থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক রাফসান আমিন বলেন, বিছনাকান্দিতে কয়েকবার ঘুরতে এসেছি কিন্তু আগের সৌন্দর্য্য এখন আর নেই। এক বছর আগেও এই স্পটে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণ পিপাসুদের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকরা ঘুরতে আসতে দেখিছি এখন আর দেখিনা। পাথর না থাকায় সৌন্দর্য্য হারিয়েছে এই স্পটটি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিছনাকান্দি পর্যটন স্পটের এক ব্যবসায়ী জানান, শুরু থেকে এখানে কসমেটিকস ও বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর দোকান দিয়ে ভালোই ব্যবসা চলছিল প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসতেন। প্রতি শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন পর্যটক বেশি আসতেন। সেই দুই দিন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বেচাকেনাও হতো। গত এক বছরে পাথর খেকো চক্র রাঁতের আঁধারে পাথর লুট করায় ধীরে ধীরে স্পটের সৌন্দর্য্য হারিয়ে গেছে। এই সৌন্দর্য্য রক্ষার্থে ইউএনও বরাবর পর্যটন স্পটের ব্যবসয়ীরা লিখিত অভিযোগ দিয়েও বন্ধ হয়নি। প্রাণনাশের ভয় কেউ প্রতিবাদ ও করেনি। স্পটের সৌন্দর্য্য হারিয়ে যাওয়ায় পর্যটক ও আসা বন্ধ হয়ে যায়। পর্যটক না আসায় ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন অনেকেই।

সাদাপাথর পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল জলিল বলেন, দীর্ঘদিন থেকে সাদাপাথর লুটপাট হওয়ার কারণে সৌন্দর্য হারাচ্ছে পর্যটনের। প্রশাসন নিরব থাকায় তারা এই সুযোগ নিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পর্যটক শূন্য হয়ে যাবে সাদাপাথর। এছাড়া পর্যটন এলাকার সৌন্দর্য বর্ধনে প্রশাসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। পর্যটকদের সুবিধার জন্য স্পটে চেঞ্জিং রুম ও ওয়াশ রুমের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে সাদাপাথর ও উৎমাছড়া নামে দুটি পর্যটন কেন্দ্র। স্বচ্ছ জলে সাদা ছোট বড় পাথর আর ভারতের চেরাপুঞ্জির পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিনই এখানে ছুটে আসেন ভ্রমণ পিপাসুরা। গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর টানা কয়েকদিন সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্র থেকেও লুট হয়েছে পাথর।

উপজেলার প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী সাদা পাথর থেকে অর্ধ শত কোটি টাকার পাথর লুটপাট করছে দুর্বৃত্তরা। উৎমাছড়া থেকেও কোটি কোটি টাকার পাথর চুরি হয়। পাথর না থাকায় আগ্রহ কমেছে পর্যটকদের। ফলে পর্যটক কমে যাওয়ায় পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবীদের আয়-রোজগার কমেছে।

এ ছাড়া সিলেটের বৃহত্তর জৈন্তা সীমান্তে রয়েছে উচু নীচু ও ঢালু পাহাড়। প্রকৃতি যেন আপন হাতে সাজিয়েছে সবুজ-শ্যামল বিস্তর প্রান্তর।

শীতকালে জাফলং, লালাখাল, শ্রীপুরের রাং পানি নদী, আদুরী ঝর্না, শ্রীপুর চা বাগান,শ্রীপুর পিকনিক সেন্টার, কানাইঘাটের লোভাছড়ায় পর্যটকদের ঢল নামে। এসব এলাকা বর্ষাকালেও পর্যটকদের উপস্থিতিতে মুখর থাকে। বর্তমানে শীতকালে জমে উঠে জৈন্তাপুরের ’লাল শাপলার বিল’।

প্রাকৃতিকভাবে ফুটে ওঠে উপজেলার সীমান্তঘেষা ডিবির হাওর ইয়ামবিল ও কেন্দ্রি বিলের মধ্যে লাল শাপলা। শীতের সকালে সূর্যদয়ের সাথে সাথে লাল শাপলা গুলো এক সাথে ফুটে ওঠে এমনই কুয়াশার চাদরে ডাকা ভোরে পর্যটকরাও ভিড় করে শাপলা বিলের সুন্দর্য অবলোকন করতে।

জল আর বনের ব্যতিক্রম মিতালীর দেখা মেলে রাতারগুলে। এরকম আরও কয়েকটি জলারবন আছে উত্তর-পূর্ব সিলেটের এ অঞ্চলে। এখন বর্ষাকালে পর্যটকরা আসেন।

বাংলাদেশের একমাত্র মিঠা পানির জলারবন রাতারগুল সোয়াম্প ফরেষ্ট যা সিলেটের সুন্দরবন নামে খ্যাত এ স্থানটি গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত রাতারগুলে প্রাকৃতিক সুন্দর্যের এক অপার বিস্ময় জলারবনের গাছগুলো বেশিরভাগই জলে ডুবে থাকে বর্ষাকালে রাতারগুলে নৌকাই প্রধান বাহক, নৌকা নিয়ে জলে মধ্যে প্রবেশ করলেই দাড়িয়ে থাকা সারী সারী হিজল করচ গাছ পর্যটকদের মুগ্ধ করেছে প্রতিনিয়ত।

ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কেন্দ্রীয় আহবায় কমিটির অন্যতম সদস্য ও সিলেট বাপার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, যে সৌন্দর্য উপভোগের জন্য মানুষ পর্যটক হিসেবে কোন এলাকা পরিদর্শনে যায় সেই সৌন্দর্যকে যদি ক্রমাগতভাবে বিনষ্ট করা হয় তবে পর্যটন সম্ভাবনা নষ্ট হতে থাকে। জাফলং, বিছনাকান্দি, সাদাপাথরে মানুষ জল ও পাথরের সৌন্দর্য পরিদর্শনে যায়। অথচ সেখানে রাতের আঁধারে পাথর লুট হয়। পাহাড় টিলা ও বৃক্ষ লুটের কারনে সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নানাভাবে হুমকির মুখে।

তিনি প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার মাধ্যমে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার কথা বলেন। কিম আরো বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার পাশাপাশি বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী খ্যাত সিলেট নগরে হযরত শাহজালাল (রহ.), হজরত শাহপরান (রহ.) সহ ৩৬০ আউলিয়ার বিভিন্ন দরগা ও মাজার পরিদর্শনে সিলেটে প্রতি সপ্তাহে অনেক পর্যটকের আগমন ঘটে। এ সমস্ত পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে মাজার এলাকার আশপাশে অসংখ্য হোটেল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মাজারে হামলার ঘটনায় পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধির পথে নিতে হলে পর্যটন এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে।

নগরীর আম্বরখানার হোটেল শেরাটন এর স্বত্ত্বাধিকারী সুজন মিয়া কালবেলাকে বলেন, সিলেটে বছরের শুরুর দিক থেকেই হোটেল ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। বন্যার পর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে পর্যটক শুন্য সিলেট। এ অবস্থায় কর্মচারীদের বেতন, ভ্যাট, টেক্স দিয়ে ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি ব্যবসায়ীদের প্রনোদনার অনুরোধ জানান।

সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মুজিবুর রহমান মিন্টু বলেন, সিলেটে পর্যটক কমে যাওয়া ব্যবসায়ীওেদর জন্য অশনি সংকেত। দফায় দফায় বন্যা, রাজনৈতিক সহিংসতার কারনে ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের বিশেষ প্রনোদল্ ানা দিলে ঠিকে থাকা সম্ভব না বলে তিনি জানান। তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়কে সিলেটের পর্যটন শিল্পের দিকে নজর দেওয়ার অনুরোধ জানান।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, সবকিছু স্থিতিশীল হচ্ছে। পাথর চুরি বা মাজারে হামলার দু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে-এটা আশা করি আর হবে না। পাথর চুরির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে। তদন্তে অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, পর্যটন এলাকায় স্যানিটেশন ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। এছাড়া নৌকা ভাড়া যেভাবে নির্ধারণ দেওয়া হয়েছে সেভাবে গাড়ি ভাড়া নির্ধারন করতে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি