অর্ধকোটি টাকা নিয়ে পালালেন হোমরান

নিজস্ব প্রতিবেদক ;
  • প্রকাশিত: ২৬ এপ্রিল ২০২২, ৯:৪৮ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২ বছর আগে

নগরীর কাজলশাহ এলাকার হোমরান আহমদ (৩৪) সিলেটে একটি বেসরকারি কোম্পানীর পণ্য প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি করতেন। কিন্তু হোমরান তার অন্নদাতা ওই প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়েই ভয়াবহ এক প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। প্যাকেজে পণ্য বিক্রির নামে হোমরান একাধিক মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। সরল বিশ্বাসে তার হাতে টাকা দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেকেই। তার প্রতারণা থেকে বাদ পড়েননি পাড়ার মুদি দোকানীও। বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে লাপাত্তা হোমরান আহমদ।

মুঠোফোন বন্ধ থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সরব তিনি। অথচ যে কোম্পানীর নাম ভাঙ্গিয়ে হোমরান আহমদ এই অপকর্ম করেছেন, মাস ছয়েক আগেই সেই কোম্পানীর চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। তার সাথে চাকরি ছাড়েন আরেক প্রতারক তোহা ভূঁইয়া। এদিকে প্যকেজ কেনার জন্য হোমরানের হাতে টাকা দেওয়া লোকজনের মাথায় হাত পড়েছে। নিরুপায় হয়ে আইনের আশ্রয়ে যাচ্ছেন তারা।

নগরীর আখালিয়া এলাকার মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের ফ্লোর ইনচার্জ মো. জামাল হাসান। একই হাসপাতালের আরেক ফ্লোর ইনচার্জ আব্দুল্লাহ আল মামুনের মাধ্যমে জামালের পরিচয় হয় নগরীর কাজলশাহ এলাকার ই-ব্লকের ১০৬ নম্বর বাসার আব্দুল আহাদের ছেলে হোমরান আহমদের (৩৪) সাথে। মামুন এবং হোমরান কাজলশাহ এলাকায় একই পাড়ায় বসবাস করেন। হোমরান আহমদ সিলেটে আবুল খায়ের কোম্পানীর পণ্য প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। সেই সুবাদে চলতি বছরের শুরুতে জামাল হাসান ও আব্দুল্লাহ আল মামুনকে এক লোভনীয় প্রস্তাব দেন হোমরান।

তিনি জানান, আবুল খায়ের কোম্পানী নতুন প্যাকেজ চালু করেছে। প্রত্যেক গ্রহীতার কাছে কমপক্ষে ২টি করে প্যাকেজ বিক্রি করা হবে। ওই প্যকেজে থাকবে আবুল খায়ের কোম্পানীর ২৪০ পিস পণ্য। ২টি প্যাকেজের মূল্য ৭২ হাজার ৭২০ টাকা। মাত্র ৩ মাসে দুই প্যাকেজে লাভ হবে ১৪ হাজার ৪শ টাকা। প্রতিটি পণ্য বিক্রি করলে ৬০ টাকা করে লাভ হবে। প্যাকেজ কেনার পর পণ্যগুলো কোম্পানীর ডিপোতেই থাকবে। কোম্পানীর মার্কেটিং ইনচার্জ ও প্রতিনিধি ওই পণ্য বিক্রি করে ৩ মাস পর লভ্যাংশসহ মূল টাকা প্যাকেজ গ্রহীতাকে হস্তান্তর করবেন। দুটি প্যাকেজ বিক্রির পর কমিশনসহ মূল টাকা, ইনসেনটিভ এবং ফেস্টিভাল বোনাস বাবদ ৯১ হাজার ৮শ টাকা ফেরত পাবেন প্যাকেজ গ্রহীতা। প্যাকেজ দুটি কেনার দেড় মাসের মাথায় একটি প্যাকেজের লাভসহ ৪৪ হাজার ৬৫০ টাকা গ্রহীতাকে প্রদান করা হবে। বাকি টাকা হাতে পাবেন আরো দেড় মাস পর।

পূর্বপরিচিত হোমরানের এমন লোভনীয় অফার তাৎক্ষণিক লুফে নেন জামাল হাসান ও আব্দুল্লাহ আল মামুন। চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি জামাল হাসান ৩শ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে দুটি প্যাকেজ কিনেন। ওই প্যাকেজের মূল্য বাবদ ৭২ হাজার ৭২০ টাকা তাৎক্ষণিক হোমরানকে দেন জামাল হাসান। আবুল খায়ের গ্রুপের লগো সম্বলিত ওই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন আবুল খায়ের গ্রুপের সিলেটের মার্কেটিং ইনচার্জ তোহা ভূঁইয়া এবং প্রতিনিধি হোমরান আহমদ। পণ্যের রসিদ জামাল হাসানকে বুঝিয়ে দেন হোমরান। এরপর ১৭ ফেব্রুয়ারি ৭২ হাজার আরো দুটি প্যাকেজ কিনেন জামাল হাসান।

গত ২০ মার্চ নির্ধারিত সময়ে হোমরান আহমদ প্রথম ধাপের ১টি প্যাকেজ বিক্রির টাকা (৪২ হাজার ৬৫০ টাকা) জামাল হাসানের হাতে তুলে দেন। এরপর, গত ২৭ মার্চ হোমরানের প্ররোচনায় ৩ লাখ ৭ হাজার ২শ টাকা দিয়ে আরো ৪টি প্যাকেজ কিনেন জামাল হাসান। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে প্যাকেজ কেনার সময় চুক্তিপত্রে দেড় মাস পর অর্ধেক টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি কৌশলে বাদ দিয়ে দেন চতুর হোমরান। ওই সময় বিষয়টি খেয়াল করেননি জামাল হাসান।

ইতিমধ্যে, হোমরানের হাতে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৩৬০ টাকা তুলে দিয়েছেন জামাল। চুক্তি অনুযায়ী আগামী ১০ মে ইনসেনটিভ ও ফেস্টিভাল বোনাসসহ প্রথম ধাপের বিনিয়োগের লভ্যাংশসহ বাকি থাকা অর্ধেক টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিলো হোমরানের। ২য় ও ৩য় ধাপের চুক্তিপত্রে অর্ধেক টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য না করায়, ২য় ধাপের একটি প্যাকেজ বিক্রির টাকার জন্য গত ৭ এপ্রিল হোমরানকে ফোন করেন প্যাকেজ গ্রহীতা জামাল হাসান। এ সময় হোমরান টালবাহানা শুরু করেন। টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য একাধিকবার সময় নেন। একপর্যায়ে ১৭ এপ্রিল বন্ধ করে দেন মুঠোফোন। ওই দিনই আবুল খায়ের গ্রুপের কর্পোরেট অফিসে যান জামাল হাসান। সেখানে জামাল হাসানকে তেমন পাত্তাই দেননি দায়িত্বরত কর্মকর্তারা। ওই অফিস থেকে মাহিদ নামের এক মার্কেটিং ম্যানেজারের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তার সাথে কথা বলেন জামাল।

মাহিদ জামালকে জানান, মাস ছয়েক আগে মার্কেটিং ইনচার্জ তোহা ভূঁইয়া এবং পণ্য বিক্রয় প্রতিনিধি হোমরান আহমদ আবুল খায়ের গ্রুপের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এমন খবরে জামাল হাসানের মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়। উপায়ান্তর না দেখে সহকর্মী মামুনকে নিয়ে কাজলশাহস্থ হোমরানের বাসায় যান জামাল। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির সহায়তায় হোমরানের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। জানতে পারেন, তার মতোই প্যাকেজ কিনে প্রতারিত হয়েছেন বেশ কয়েকজন।

জামালের ভাষ্য অনুযায়ী, তার সহকর্মী আব্দুল্লাহ আল মামুনও প্যাকেজ কেনা বাবদ হোমরানের কাছে প্রায় ২ লাখ টাকা দিয়েছেন। কাজলশাহ এলাকার মুদি দোকানী লিটন দিয়েছেন প্রায় ১০ লাখ টাকা। ওসমানীনগর উপজেলার নাজিরবাজার এলাকার এক ব্যবসায়ীর ১৩ লাখ এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলার কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা প্যাকেজ বিক্রির নামে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন হোমরান আহমদ। এভাবে তিনি বিভিন্নজনের কাছ থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পলাতক হন।

এদিকে, সম্প্রতি সিলেট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে নিজের নামে পাসপোর্টের আবেদন করেন প্রতারক হোমরান। পাসপোর্টটি (নম্বর-এ০৩০০৫১০৬) তার হাতে আসে ৩ এপ্রিল। টার্গেট ছিলো, টাকা হাতিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু ভুলক্রমে পাসপোর্টটি বাসায় রয়ে যায়। স্থানীয় মুরব্বিদের হস্তক্ষেপের কারণে এখনো সেটি নিতে পারেননি হোমরান।

এ ব্যাপারে হোমরান আহমদের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

তবে, মুঠোফোন বন্ধ থাকলেও, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে নিয়মিত সক্রিয় থাকেন হোমরান। প্রতারিত জামাল হাসান জানান, হোমরানের সাথে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকে যোগাযোগ রয়েছে নিকটাত্মীয় ও পরিচিতজনদের। হোমরান বিদেশে পালানোর চেষ্টা করছেন।

অবশেষে নিরুপায় হয়ে আইনের আশ্রয় নিতে যাচ্ছেন প্রতারণার শিকার হওয়া জামাল হাসান। বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি বলেন, দেশের স্বনামধন্য একটি কোম্পানীর নাম ভাঙ্গিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক হোমরান। সে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে ৬ মাস আগে চাকরি ছাড়লেও, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি কিংবা গ্রাহকদের বিষয়টি জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি কোম্পানীর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। কোম্পানী হোমরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কি না জানিনা। তবে আমি আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আমরা যারা প্রতারিত হয়েছি, সকলেই মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ, আমাদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে প্রতারক হোমরান।

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি