সব
পৃথিবীর নিজেরই বিস্ময় ও মায়াজালের শেষ নেই,তার উপর আবার মহাবিশ্বকে নিয়ে ভাবতে কেইবা সাহস করে? আবার ভাবতে গেলেও অনেকেই বলে বসেন,কি দাদা? ঘরের খেয়ে, বনের মোষ তাড়ানোর কি দরকার?? কিন্তু মানুষ মাত্রই জ্ঞান পিপাসু, কোন গোলকধাঁধা মাথায় একবার গেঁথে গেলে তার শেষ দেখেই দম নেয়। তেমনি পদার্থবিদদের কাছে এই মহাবিশ্বের সবথেকে বড় একটি গোলকধাঁধার নাম হলো ব্লাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর বা কৃষ্ণবিবর।
সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে, কৃষ্ণগহ্বর মহাকাশের এমন একটি বিশেষ স্থান যেখান থেকে কোন কিছু, এমনকি সর্বোচ্চ গতিসম্পন্ন ইন্টিটি ‘আলো’ পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পারে না।একে অনেকটা ভ্যাকুমক্লিনারের সাথে তুলনা করা যেতে পারে অর্থাৎ কোন কিছু এর কাছাকাছি থাকলে এই গহ্বর সেটি শুষে নেয় হোক সেটি কোন গ্রহ,উপগ্রহ,ধুমকেতু অথবা স্পেসক্রাফট।
পৃথিবীতে যে ব্লাক হোল রয়েছে তার সর্বপ্রথম ধারণা পাওয়া যায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্রিটিশ ভুতত্তবিদ জন মিচেল এর মাধ্যমে। ১৭৮৩ সালে তিনি বলেন যে, যদি একটি বস্তুর আকার যথেষ্ট ছোট ও ভর যথেষ্ট হয় তবে তার মহাকর্ষের প্রভাবে সেখান থেকে কোন আলোক তরঙ্গ বের হয়ে আসতে পারে না।তিনি এদের নাম দেন অন্ধকার নক্ষত্র। ১৭৯৬ সালে গণিতবিদ পিয়েরে সিমন ল্যাপলেস তার ‘Exposition du systeme du Monde‘ বইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে একই মতবাদ প্রদান করেন।
১৯১৬ সালে স্যার আইনস্টাইন তার “জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্ব ” দিয়ে ধারনা করেন ব্ল্যাকহোল থাকা সম্ভব।তার আপেক্ষিক সূত্রানুযায়ী, মহাকর্ষ বল যেখানে বেশি, সেখানে সময় তত ধীরে অতিবাহিত হবে,অথাৎ মহাকর্ষ সময় কে মন্থর করে দিতে পারে।জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জস্কাইল্ড ১৯১৬ সালে আইন্সটাইনের এই আপেক্ষিক তত্ত্বের সাহায্যেই দেখান যে, যেকোন তারকা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে পারে।১৯৬৭ সালে হুইলার ‘ব্ল্যাক হোল’- নামটির সাথে আমাদের প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, ব্লাক হোল কিভাবে তৈরি হয়?
দৃশ্যমান মহাবিশ্বে (The observable universe) রয়েছে কমপক্ষে একশ বিলিওন মিল্কিওয়ে বা ছায়াপথ।আবার প্রতিটা ছায়াপথে রয়েছে ১০০ ট্রিলিওনের বেশি তারা বা নক্ষত্র। নিউক্লিয়ার ফিউশন বা সংযোজন বিক্রিয়ার কারণে নক্ষত্রের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত বিস্ফোরণ হয়ে থাকে। একাধিক হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রে হিলিয়াম অনু তৈরি করে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে শক্তি হিসাবে নির্গত করে তেজস্ক্রিয়তা,তাপ,আলো ইত্যাদি। কিন্তু নক্ষত্রের এই নিউক্লীয় জ্বালানি(হাইড্রোজেন) শেষ হয়ে গেলে তাদের নিউক্লীয় বিক্রিয়া বন্ধ হয় । ফলে কেন্দ্রমুখী সংকোচনধর্মী চাপ এই নিউক্লীয় বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট বর্হিমুখী চাপের প্রভাব থেকে বেশি হয়, ফলে তারার সকল ভর কেন্দ্রে সংকুচিত হতে শুরু করে এবং এক সময় সেটি চুপসে যেয়ে ব্লাক হোলে পরিণত হয়।
আমাদের সূর্যের মত ছোট তারকাগুলোর জ্বালানী শেষ হয়ে যাওয়ায় এবং যথেষ্ট ভর না থাকায় সেগুলো বিক্রিয়া চালাতে সক্ষম হয় না ফলে তখনই তাদের মৃত্যু ঘটে। এই অবস্থায় এদেরকে বলা হয় শ্বেত বামন (White Dwarf)। সংযোজন বিক্রিয়া শেষ হয়ে গেলেও অত্যাধিক তাপমাত্রার কারণে এরা জ্বলজ্বল করতে থাকে এবং বিলিয়ন বিলিয়ন বছর পরে এগুলো নীরবে ঠাণ্ডা হয়ে যে অবস্থায় রুপান্তরিত হয় যাকে বলা হয় Planetary Nebula বা নীহারিকা ।নীহারিকা থেকেই পরবর্তীতে সৃষ্টি হয় নতুন নতুন গ্রহ নক্ষত্রের।
তবে কিছু নক্ষত্র রয়েছে যাদের অভ্যন্তরীণ প্রচন্ড চৌম্বকক্ষেত্রের আকর্ষনের ফলে শক্তিশালী আলোক রশ্মি নির্গত হয় যা ডিম লাইটের টিমটিম আলোর মত জ্বলছে আর নিভছে মনে হয়। এই ধরনের নক্ষত্রকে বলা হয় Pulsar যারা সুপারনোভা বিস্ফোরণের পরেও বেঁচে থাকে।
সূর্যের শত শত গুন বড় নক্ষত্র (Super massive Stars) গুলোর মধ্যে বিষ্ফোরণ হলে তাদের বলে হাইপার নোভা (Hyper Nova). এই বিস্ফোরণগুলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় ও উজ্জ্বলতম বিস্ফোরণ, যার প্রথম ১ সেকেন্ডে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, তা আমাদের সূর্যের সারা জীবনে (নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত) নির্গত সব শক্তির চেয়ে ১০০ গুণ বেশি হয়ে থাকে।
ব্লাক হোলকে চোখে দেখা একপ্রকার অসম্ভব,শুধু এর সীমানা কে উপলব্ধি করা যায় মাত্র।আর এই সীমানা কে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত। এই সীমানার মধ্যে প্রবেশ করলে কোন কিছুই আর ফেরত আসতে পারে না। সরাসরি কেন্দ্রে পতিত হয় যার নাম ব্লাক হোল সিঙ্গুলারিটি। এটি হলো সেই যায়গা যেখানে স্পেস এবং টাইম এক হয়ে যায়।
পৃথিবীতে যে সংখ্যক ব্লাক হোল রয়েছে সেই সংখ্যা বিজ্ঞানীরা নিছক কল্পনা করতে পারেন মাত্র। কেননা কেবলমাত্র আমাদের গ্যালাক্সিতেই শত কোটি কোটি ব্লাক হোল রয়েছে। এর মধ্যে আকার আকৃতির ভিত্তিতে ব্লাক হোলকে সাধারনত দুই ভাগে ভাগ করেছেন বিজ্ঞানীরা।তার মধ্য সুপার নোভা ব্লাক হোল হলো সবচেয়ে বিশাল,যেটি প্রতি গ্যালাক্সিতে মাত্র একটিই থাকতে পারে।
এটি সূর্যের থেকেও লক্ষ লক্ষ গুন এমনকি কোটি কোটি গুন বড় হতে পারে।এর অবস্থান গ্যালাক্সির ঠিক মাঝামাঝি যায়গায়। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেও একটি সুপার নোভা ব্লাক হোল পাওয়া গেছে যার নাম দেয়া হয়েছে সিজাটেরিয়াস ‘এ’।এটি আমদের সৌরজগৎ থেকে প্রায় ২৬ হাজার আলোক বর্ষ (light years) দূরে যা সূর্যের চেয়ে প্রায় ৪০ লক্ষ গুণ ভারী।
আরেক ধরণের ব্লাক হোল হলো স্টেলার ব্লাক হোল। এটি তুলনামূলক অনেক ছোট কিন্ত সূর্যের চেয়েও ১০ থেকে ২০ গুন বড়। এটি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় গ্যালাক্সির চারপাশে ঘুরতে থাকে।মাত্র একটি গ্যালাক্সিতেই লক্ষ লক্ষ স্টেলার ব্লাক হোল থাকতে পারে।
এছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরণের ব্লাক হোল থাকতে পারে তেমনি একটি চমৎকার ধরণের ব্লাক হোল হলো প্রেমরডিয়াল ব্লাক হোল যার ভর একটি পাহাড়ের সমান কিন্তু আয়তন একটি ক্ষুদ্র পরমানুর চেয়েও ছোট।উল্লেখ্য যে,ভর ঠিক রেখে পৃথিবীকে ছোট করতে করতে যদি একটা চীনা বাদামের সমান করা যায় তাহলে ওই চীনা বাদামটা হবে পৃথিবীর ব্ল্যাক হোল।
এছাড়াও ইন্টারমিডিয়েট ব্ল্যাকহোল এবং মাইক্রো ব্ল্যাকহোল অবশিষ্ট ব্লাক হোল ধরণের মধ্যে অন্যতম।
তবে আরেকটি প্রশ্ন থেকেই যায় তা হলো ব্লাক হোল কি আজীবন এভাবেই থেকে যাবে নাকি এর কোন শেষ রয়েছে। সেটির উত্তর দিয়েছেন এই সময়ের বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং তার ‘এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ টাইম’ বইয়ের মাধ্যমে ।১৯৭৪ সালে তিনি কোয়ান্টাম মেকানিজম এর সাহায্য নিয়ে প্রমাণ করেন যে ব্ল্যাক হোলগুলো থেকে প্রতিনিয়ত রেডিয়েশন বিকিরিত হতে হতে এক সময় (বিলিওন ট্রিলিওন বছর) এটি শূন্যে মিলিয়ে (Evaporate) যাবে।আর সেই কারনেই এই তত্ত্বের নাম দেয়া হয় ‘হকিং বিকিরণ’।
স্টিফেন হকিংয়ের মতই ব্লাক হোল সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের নিরন্তর নতুন কিছু আবিস্কারের এই প্রচেষ্টাই একসময় সবকিছু খোলাসা করবে যার উত্তর আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি।
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি