সিলেটে ‘৯৯৯’ হয়ে উঠেছে আস্থার প্রতীক

মো. জেদান আল মুসা;
  • প্রকাশিত: ২২ মে ২০২১, ২:৪২ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২ বছর আগে

‘৯৯৯’। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে পরিচালিত একটি জর”রি কল সেন্টার। যা দেশের জাতীয় জর”রি সেবা হিসেবে পরিচিত। ইতোমধ্যে সেবাপ্রত্যাশীদের কাক্সিক্ষত সেবা প্রদানের মাধ্যমে সার্ভিসটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর যাত্রা শুর” হয় এ সেবার। যে কোনো মোবাইল নম্বর থেকে সম্পূর্ণ টোল ফ্রি কল করে যে কেউ জর”রি মুহূর্তে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা পেয়ে থাকেন এ সেবার মাধ্যমে। রাস্তায় কোনো অপরাধ ঘটতে দেখলে প্রতিবাদ করতে না পারার মর্মবেদনা নিয়ে এখন আর কাউকে আর বাড়ি ফিরতে হবে না। একজন নাগরিক হিসেবে ৯৯৯-এ ফোন করে প্রতিবাদের সুযোগ রয়েছে এখন। তারপরও অনেকেই এ ধরনের ঘটনা দেখে এড়িয়ে যান পুলিশি ঝামেলার কথা ভেবে। কিন্তু ৯৯৯-এ ফোন দিলে কোনো ভোগান্তিতে পড়তে হয় না। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। সিলেট রেঞ্জে ক্রমেই আস্থার প্রতীক হয়ে উঠছে ‘৯৯৯’ বা ট্রিপল নাইন।

ট্রিপল নাইন সেবা চালু হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সোয়া তিন বছরে সিলেট রেঞ্জের আওতাধীন সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় এ মোট ৪ হাজার ১৪৮টি কল এসেছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ৮৭টি, ২০১৮ সালে ৬৬৯টি, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৬৭টি, ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৮টি এবং চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে ৬৬৭টি কল এসেছে ‘৯৯৯’-এ। প্রতিবছরই কলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুর্ঘটনায় সহায়তা, বাল্য বিবাহ রোধ, খুন, ডাকাতি, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধে অপরাধীদের গ্রেফতার, গৃহকর্মী নির্যাতন রোধ, পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ ইত্যাদিতে ৯৯৯-এ তথ্য দিয়ে সিলেট রেঞ্জে পুলিশকে সাহায্য করার পাশাপাশি কাক্সিক্ষত সেবা নিচ্ছেন হাজার হাজার জনসাধারণ। কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

কেস স্টাডি ১ : ২০২০ সালের তারিখে মৌলভীবাজার থেকে এক ব্যক্তি ৯৯৯-এ ফোন করে জানান, একদল ডাকাত তার বসতঘরের প্রধান ফটকের কলাপসিবল গেইটের তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে সকলকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ডাকাতি করেছে। ৯৯৯ কন্ট্রোল র”ম থেকে তার কলটি ট্রান্সফার করা হয় মৌলভীবাজার সদর থানায়। অভিযোগের প্রেক্ষিতে মৌলভীবাজার পুলিশ কাগাবলা ইউনিয়নের বুর”তলা এলাকায় তাৎক্ষণিক চেকপোস্ট বসায়। পালিয়ে যাওয়ার সময় চেকপোস্টের সামনে পড়ে ডাকাত দল। এ সময় তারা চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে। পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালালে এক ডাকাত গুলিবিদ্ধ হয়। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ২টি পাইপগান, নগদ টাকা, ল্যাপটপ, মোবাইলফোন, টর্চলাইট, ইমিটিশনের গহনা ব্যাগসহ মোট দুই লক্ষাধিক টাকা টাকা মূল্যের মালামাল উদ্ধার করে।

কেস স্টাডি ২ : ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট হবিগঞ্জের জেলার বানিয়াচং উপজেলার জনৈক ব্যক্তি ৯৯৯-এ ফোন করে জানান, দৌলতপুরের জনৈক আহমদ উল্লার ছেলে সোহেল মিয়া ২৩ বছর বয়সী এক তর”ণীকে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। ওই সংবাদের ভিত্তিতে স্থানীয় থানা পুলিশ তর”ণীকে দৌলতপুর গ্রাম থেকে উদ্ধার করে তার অভিভাবকের কাছে পৌঁছে দেয়।

কেস স্টাডি ৩ : ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের জেলার বানিয়াচং উপজেলার জনৈক ব্যক্তি ট্রিপল নাইনে ফোন করে জানান, গাজীপুরে জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে সংঘর্ষ হচ্ছে। পুলিশ দ্র”ত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ৯ জনকে আটক করে। পুলিশ যাদের আটক করে তারা নূর”ল হক নামের এক ব্যক্তিকে দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো।

কেস স্টাডি ৪ : ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা থেকে জনৈক ব্যক্তি ৯৯৯-এ ফোন করে জানান, চিকনাগুল ইউনিয়নের তামাবিল-সিলেট মহাসড়কে একটি ফিলিং স্টেশনের কাউন্টারের দরজা ভেঙে ডাকাতদল প্রবেশ করেছে। কন্ট্রোল র”ম থেকে ট্রান্সফার হয়ে আসা কলের মাধ্যমে জানতে পেরে জৈন্তাপুর মডেল থানা পুলিশ তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে পৌঁছে। স্থানীয় বাজারের পাহারাদারদের সহায়তায় ৩ ডাকাতকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন ও ১১টি দা উদ্ধার করে।

কেস স্টাডি ৫ : ২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার এক ব্যক্তি ৯৯৯-এ ফোন করে জানান কালিগঞ্জ বাজারে একটি পিকআপ ভ্যান একটি শিশুকে চাপা দিয়ে পালিয়ে গেছে। কন্ট্রোল র”ম থেকে ওই কলটি বিশ্বনাথ থানায় ট্রান্সফার করা হলে থানা পুলিশ রাস্তায় ব্যরিকেড দিয়ে গাড়িটি আটক করে। স্থানীয় লোকজন আহত শিশুটিকে সাদিপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক আতিকুর রহমানকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় পরবর্তীতে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

কেস স্টাডি ৬ : ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের জেলার বানিয়াচং উপজেলার জনৈক ব্যক্তি ট্রিপল নাইনে ফোন করে জানান, বড়ইউরি গ্রামের জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে সংঘর্ষ হচ্ছে। পুলিশ দ্র”ত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ৪ জনকে আটক করে। পুলিশ যাদের আটক করে তারা তানভীর মিয়া (২০) নামের এক তর”ণকে দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো।

এভাবে প্রতিদিনই সেবা প্রত্যাশীরা জাতীয় জর”রি সেবা ৯৯৯-এ কল দিয়ে তাদের কাক্সিক্ষত সেবা নিচ্ছেন। এ সেবা পেতে হলে বাড়তি কিছুই করতে হয় না। শুধুমাত্র ৯৯৯-এ একটি কলই যথেষ্ট। বাকি কার্যক্রম হেল্পডেস্ক থেকে করা হয়ে থাকে। তাই যে কেউই নির্ভয়ে আশেপাশের অন্যায় অনিয়ম, দুর্ঘটনাসহ যেকোন অসঙ্গতিপূর্ণ কাজে জাতীয় জর”রি সেবা ৯৯৯-এ কল করে সঠিক তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত সেবা নিতে পারেন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশকে সহায়তা করতে পারেন।

বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহীসোপানে অবস্থান করছে। বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলার। জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের বাস্তবায়নে তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিশন ২০২০ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ভিশন ২০৪১ ঘোষণা করেছেন। এই অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ পুলিশও সক্রিয় অংশীদার। নিরবচ্ছিন্ন এই উন্নয়ন টেকসই করার লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার আন্তরিকতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সাথে নিয়মিতভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক ও সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশ পুলিশ সর্বদা সচেষ্ট রয়েছে। বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা এবং পুলিশের সেবাসমূহ জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছিয়ে দিতে ৯৯৯ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ক্রমেই ৯৯৯ হয়ে উঠেছে জনগণের আস্থার প্রতীক।

লেখক : পুলিশ সুপার (এমএন্ডসিএ), রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয়, সিলেট

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি