সিলেটে ফায়ারম্যানরা ‘রাজমিস্ত্রী’

জিকরুল ইসলাম;
  • প্রকাশিত: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:২৭ অপরাহ্ণ | আপডেট: ৫ বছর আগে

অগ্নিকান্ড- কিংবা যে কোনো দুর্যোগকালীন মুহুর্ত, ইমার্জেন্সি সাইরেন বাজার মাত্র ৩০ সেকেন্ডে প্রস্তুত হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। দিন-রাত, সময়-অসময় নেই। ২৪ ঘন্টাই প্রস্তুত থাকতে হয় তাদের। ছুটি মেলে, তাও সামান্য। সিলেটের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাধারণ ফায়ারম্যানদের অবস্থা আরো শোচনীয়। উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার নির্দেশে ‘রাজমিস্ত্রী’র কাজও করতে হয় তাদের। নিয়ম বহির্ভূতভাবে অমানবিক আচরণ করা হয় সিলেটের সাধারণ ফায়ারম্যানদের সাথে। পান থেকে চুন খসলেই শুনতে হয় অকথ্য গালিগালাজ।
সাধারণ মানুষের কাছে ‘দুর্নীতিবিহীন’ সরকারি দপ্তর হিসেবে পরিচিত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিলেট অফিসে মিলেছে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ। চলতি বছরের শুরুতে সিলেটের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক অবসরজনিত ছুটিতে যাওয়ার পর তার স্থলে ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন সহকারী পরিচালক কোবাদ আলী সরকার। তার বিরুদ্ধে উঠেছে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। ফায়ার সার্ভিসের সিলেটের বিভাগীয় সহকারী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক (ডি.ডি) কোবাদ আলী সরকারের বিরুদ্ধে তার অধীনস্থ কর্মচারীরাই এই অনিয়ম দুর্নীতি ও নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছেন। তার অনিয়ম দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারে বিরক্ত সিলেট ফায়ার সার্ভিসের সর্বস্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

জানা গেছে, নগরীর তালতলায় অবস্থিত সিলেট ফায়ার স্টেশনের প্রবেশপথে পাশেই চলছে একতলাবিশিষ্ট তথ্য ও সেবা কেন্দ্রের নির্মাণকাজ। কিন্তু তথ্য সেবাকেন্দ্র নির্মাণে রাজমিস্ত্রি নয়, কাজ করেছেন ফায়ারম্যানরা। সম্পূর্ণ অমানবিক ও নিয়ম বহির্ভূতভাবে সাধারণ ফায়ারম্যানদের এ কাজে বাধ্য করেছেন ভারপ্রাপ্ত ডি.ডি কোবাদ আলী সরকার। বদলীসহ বিভিন্ন ভয় দেখিয়ে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অগ্নি নির্বাপক কর্মীদের দিয়ে অমানবিকভাবে রাজমিস্ত্রিদের কাজ করানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

সিলেট ডাইরির সংরক্ষিত একাধিক ছবি ও ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, হাতুড়ি দিয়ে ইট-পাথর ভাঙছেন সিলেট ফায়ার স্টেশনের ফায়ারম্যানরা। তারা পাথর-সিমেন্ট-বালুর মিশ্রণও তৈরি করছেন। কেউবা পিকআপ থেকে বালু নামাচ্ছেন বেলচা দিয়ে। শুধু সিলেট ফায়ার স্টেশন নয়, দক্ষিণ সুরমা ফায়ার স্টেশনে কর্মরত ফায়ারম্যানদের দিয়েও শ্রমিকের কাজ করিয়েছেন তিনি। শ্রমিকদের ভাতা দেওয়ার নামে তিনি সরকারি কোষাগার থেকে টাকা উত্তোলন করছেন ঠিকই। কিন্তু অমানবিক খাটুনির পরও সে টাকার কানাকঁড়িও পায়নি শ্রমিকরূপী সিলেটের ফায়ারম্যানরা। নিয়মিত দুর্নীতি ও অনিয়ম চালিয়ে গেলেও, কোবাদ আলীর সরকারের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পান না কেউই। তার অধীনস্থ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুরো সিলেট বিভাগই কোবাদ আলী সরকারের কাছে জিম্মি।

কোবাদ আলী সরকারের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি নির্যাতিত কর্মচারীরা।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, কোবাদ আলী সরকার সিলেট বিভাগে যোগদানের পর থেকে তার কিছু কার্যক্রম, আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় তিনি ফায়ার সার্ভিসের বিভাগীয় কারিগরি কারখানায় কর্মরত চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সাথে অত্যন্ত খারাপ আচরণ ও জঘন্য ভাষায় গালগালাজ করেন। অভিযোগে সিলেট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডেফেন্সের সহকারী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক কোবাদ আলী সরকারের দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরেন কর্মচারীরা। অভিযোগে বলা হয়, ফায়ার সার্ভিসের সিলেট বিভাগীয় কারখানায় দক্ষ ওয়েলডার ও ওয়েলডিং মেশিন থাকা স্বত্বেও তিনি সিলেট বিভাগে রক্ষিত বিভিন্ন নতুন স্টেশনের নতুন ২২ টি গাড়ীর উইনশিল্ড গ্রীল বাইরের প্রতিষ্ঠান দিয়ে তৈরি করে গাড়িতে লাগিয়েছেন কোবাদ আলী সরকার। তিনি প্রতিটি গ্রীলে অতিরিক্ত খরচ দেখিয়েছেন, যা সরকারি টাকার অপচয়।

সিলেট বিভাগের জন্য বরাদ্দকৃত ২টি পাজেরো গাড়ির মধ্যে একটি উপ-পরিচালক এবং আরেকটি সহকারী পরিচালককে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছে। উপ-পরিচালক (ডি.ডি) না থাকায় ভারপ্রাপ্ত ডি.ডি’র দায়িত্ব পালনকারী কোবাদ আলী সরকার বর্তমানে ডি.ডি’র গাড়ি ব্যবহার করছেন। গাড়িটির কন্ডিশন খুবই ভালো। কিন্তু কোবাদ আলীর জন্য বরাদ্দকৃত পাজেরো গাড়িটি গ্যারেজে পড়ে থাকা স্বত্বেও তিনি দুটো গাড়ির ভুয়া মেরামত ও ডিকলারেশন বিল করেছেন যা সরকারি রাজস্ব খাতের অপচয়।

অভিযোগে আরো বলা হয়, দক্ষিণ সুরমা ফায়ার স্টেশনে একটি ৫০/৭০ ফুট টিনশেড ঘর বানিয়েছেন কোবাদ আলী সরকার। সেই ঘরের ২০টি এম এস পিলার স্টেশনে রক্ষিত পুরোনো পাইপ দিয়ে বিভাগীয় কারখানার ওয়েল্ডার দিয়ে মেরামত করে লাগিয়েছেন। শুধু টিনের চালের ফিটিং ছাড়া ওই ঘর নির্মাণের সর্ম্পূণ কাজ করেছেন দক্ষিণ সুরমা স্টেশনের ফায়ারম্যানরা। কোনো নির্মাণ শ্রমিক সেখানে ব্যবহার করা হয়নি। ফায়ারম্যানদের দিয়েই মিস্ত্রীর কাজ করানো হয়েছে। অথচ, শেড নির্মাণের কোটেশন বিলে ২০টি পিলার নতুন ক্রয় ও লেবার খরচ দেখিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত ডি.ডি কোবাদ আলী সরকার। যা সম্পূর্ণ বেআইনী এবং বড় ধরণের আর্থিক অনিয়ম বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, করোনাপরিস্থিতির কারণে যখন সারা দেশে বাস চলাচল বন্ধ, সেখানে কোনো ধরণের সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) ছাড়া এক প্রকার জোর করে ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল দিয়ে বিভাগীয় কারিগরি কারখানার শ্রমিকদের বিভিন্ন স্টেশনে ট্যুরে পাঠান তিনি। কোবাদ আলী সরকারের এমন কর্মকা-ের প্রতিবাদ করায় অনেক আগে থেকে তালতলা ফায়ার স্টেশনের ব্যারাক থেকে কারখানার শ্রমিকদের বের করে দিতে চাচ্ছিলেন। সর্বশেষ করোনাপরিস্থিতির দোহাই দিয়ে তালতলার ব্যারাক থেকে দক্ষিণ সুরমার নবনির্মিত ফায়ার সার্ভিস কমান্ড এন্ড কন্ট্রোল সেন্টারের বিল্ডিংয়ের গ্যারেজে দুজন ও পাশের একচালা ভাঙ্গা টিনশেডে ৫ জন থাকার ব্যবস্থা করে দেন তিনি। ভাঙ্গা টিনশেড ঘরে অল্প বৃষ্টিতেই পানি পড়ে। জানালা ভাঙ্গা, গাদাগাদি করে অত্যন্ত অমানবিকভাবে বসবাস করছেন কারিগরী কারখানার মেকানিকরা। এমনকি তাদের পাশের কক্ষে করোনায় আক্রান্ত ব্যাক্তিদেরও রাখা হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। কেউ ভয়ে কোবাদ আলী সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে না। প্রতিবাদ করায় বিভাগীয় কারিগরি কারখানার শ্রমিক ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের এ অবস্থা। তিনি যোগদানের পর থেকে তার কিছু কার্যক্রম ও আর্থিক অনিয়মের প্রতিবাদ করায় তিনি কর্মচারী ও মেকানিকদের সাথে অত্যন্ত খারাপ আচরণ ও জঘন্য ভাষয়ায় গালিগালাজও করেন। চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর ডাকযোগে অভিযোগ প্রেরণ করেন সিলেট বিভাগীয় কারিগরি কারখানার কর্মচারীরা।

এ ব্যাপারে সিলেট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক কোবাদ আলী সরকার বলেন, মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়েরের ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা। সিলেট ফায়ার স্টেশনে সিলেটের মানুষের সেবার জন্য ডিজি মহোদয়ের অনুমতি নিয়ে আমি তথ্যসেবা কেন্দ্র বানাচ্ছি। তথ্যকেন্দ্রের জন্য ডিজি স্যার একটা ফান্ড দেবেন। সেখানে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। আমি রেগুলার রাজমিস্ত্রির বিল দিচ্ছি। ফায়ারম্যানরা দুয়েকজন হয়তো সাহাযোগিতা করতেই পারে। আমি ছিলাম না, হয়তো তারা ব্যাক্তিগত কোনো কাজ করতে পারে। গাড়ির মেরামতের বিষয়টি অধিদপ্তরের অনুমোদন আছে। শেড নির্মাণে অধিদপ্তরের ডিজির অনুমোদন আছে। ফায়ারম্যান ও কর্মচারীদের সাথে খারাপ আচরণের ব্যপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এগুলা যে কেউ বলতেই পারে। আপনি আসেন, আমার বক্তব্য নিতে পারবেন সামনাসামনি আসলে। সামনাসামনি কথা বলে যদি খারাপ মানুষ মনে হয় তাহলে রিপোর্ট করেন।

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি