সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কিছু কথা

শওকত আখঞ্জী;
  • প্রকাশিত: ৮ আগস্ট ২০২০, ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ৪ বছর আগে

 মানুষ সৃষ্টির সেরা মননশীল জীব।সৃষ্টির মধ্যে মানুষই একমাত্র যে অন্য সৃষ্টি প্রাণীদের মত শুধু সে খেয়ে-পরে বেচে থাকতে পারে না। মানুষ সুস্থভাবে বাঁচার জন্য তার মননশীলতার চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজনে মননশীলতার চর্চা করতে গিয়ে মানুষই সৃষ্টি করেছে বিজ্ঞান,সাহিত্য,শিল্প ইত্যাদি বিষয়। সাহিত্য বলতে আমরা বুঝি কোনো লিখিত কোন বিষয় বস্তুকে বুঝায়। সাহিত্য শিল্পের একটি অংশ বলে বিবেচিত হয় অথবা কোনো লেখনী যেখানে শিল্পের এবং বুদ্ধির সন্ধান পাওয়া যায়! এই লেখা গুলা বিশেষ করে সাধারণ লেখনী থেকে আলাদা হয়৷ মানুষ তার ইন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক অথবা মহাজাগতিক চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি,সৌন্দর্য ও শিল্পের লেখকের লিখিত বাস্তব জীবনের অনুভূতি হচ্ছে সাহিত্য। সাহিত্যকে কল্পকাহিনি অথবা বাস্তব কাহিনি কিংবা গদ্য-পদ্য নাম দিয়ে দুইভাগে ভাগ করা যায়। পদ্যের মধ্যে থাকে ছড়া,কবিতা ইত্যাদি,আর গদ্যের মধ্যে থাকে গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইত্যাদি শাখা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। এছাড়া অনেকে নাটককে আলাদা প্রধান শাখা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেন। নাটকের মধ্যে থাকে নাটিকা,মঞ্চনাটক ইত্যাদিকে ভুক্ত করা যায়। মানুষ সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবে চলতে গেলে উল্লেখিত এগুলোর মধ্যে কোনটিকেই তার জীবন থেকে বাদ দিয়ে চলতে পারে না । মানবজীবনে শুধু বিজ্ঞান নয়,সাহিত্য,শিল্প প্রভৃতি বিষয়ের চর্চাকেও জীবনে গুরুত্ব দিতে হবে। সাহিত্য আমাদের দৈনিন্দিন মৌলিক প্রয়োজনীয়তার অভাব-অনটন,আবাসন ইত্যাদি সমস্যার সমাধান করতে পারে না এটা ঠিক কিন্তু সাহিত্য আমাদের বাস্তব থেকে এক কল্পনার জগতেই নিয়ে যায়। মানবজীবনে সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা বিভিন্ন দিক থেকে পরিলক্ষিত করা হয় বিশ্বকবি লিখেছেনঃ “বিশাল বিশ্বের আয়োজন, মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ । সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণ বৃতান্ত আছে যাহে অক্ষয় উৎসাহে। কাল অনন্ত। পৃথিবী বিপুলা। অনন্ত কালের মাঝে জীবন ক্ষণস্থায়ী বুদবুদের মত” মানব জীবন ক্ষণস্থায়ী এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে পৃথিবীর অনেক আয়োজন প্রত্যক্ষ করা সব আমাদের পক্ষে সম্ভব না । ক্ষণিকের পৃথিবীতে এসে যারা পৃথিবীকে অল্প-বিস্তর প্রত্যক্ষ করে গেছেন অনেকেই তারা তাদের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান লিপিবদ্ধ করে গেছেন পুস্তিকা আকারে। সেই পুস্তিকা পাঠ করে আমরা পৃথিবীর অপার রহস্যকে মানসচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারি। গ্রন্থ পাঠ লব্ধ জ্ঞান পরোক্ষ হলেও তা থেকে আমরা যে আনন্দ পাই তার গুরুত্ব অপরিসীম। সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়েই হয় জ্ঞানের প্রসার,সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতি। মনিষীরা তাদের জীবন চর্চা, অনুভূতি,সাফল্য ও ব্যর্থতার কারন প্রভৃতি সাহিত্যের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করে যান। পরবর্তী কালের জ্ঞান পিপাসু মানুষ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং নিজেদের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান তাতে সংযোজিত করে গ্রন্থ আকারে রেখে যান পরবর্তীদের জন্য। এভাবেই হয় সভ্যতার অগ্রগতি,জ্ঞানের প্রসার। “বই পড়ার অভ্যাস নেই আর পড়তে জানেনা এমন লোকের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই” The man who does not read has no advantage over the man who cannot read. মার্ক টোয়েইন (Mark Twain) সংবাদ লাভ জ্ঞান পিপাসা মানুষের অন্তরের প্রবৃত্তি। মানুষ স্বভাবত সে অজানাকে জানতে চায়,অচেনাকে চিনতে চায়,অদেখাকে দেখতে চায় এটা স্বাভাবিক । ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরা সে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পরে পথে,স্বীকার করে অনেক কষ্ট ও দুঃখকে।পৃথিবী বিপুলা। এর কোথাও আছে দূর্গম গিরি ,কোথাও কান্তার মরু ,কোথাও বা দুস্তর পারাবার।এসব জায়গায় আমাদের সকলের পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের ক্ষণিকের জীবনে সৃষ্টির যে বিশাল আয়োজন প্রত্যক্ষ করাও যায় না। কিন্তু যারা কিছুটা অন্তত প্রত্যক্ষ করেছেন তারা তাদের ভ্রমনলব্ধ জ্ঞান লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাদের ভ্রমণ কাহিনীতে। এইসব ভ্রমণ কাহিনী পাঠ করেই আমরা জানতে পারি বিভিন্ন দেশের লীলাভূমি,বিভিন্ন জনগোষ্ঠির জীবন যাত্রার মানের কথা এবং কৃষ্টি-কালচার নিয়ে। পৃথিবীতে সব চাইতে দূর্গম মানুষ সে দূর্গম আপন অন্তরালে। হৃদয়ের সাথে হৃদয় যোগ করতে না পারলে সে অন্তর্লোকের সন্ধান পাওয়া যায় না। আমাদের সকলের পক্ষে সে কাজ করা সম্ভব নয় মনিষীগণ যারা মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতে পেরেছেন,তাদের হৃদয়লোকের সন্ধান পেয়েছেন,তারা মানুষের হৃদয়ের কথা লিখে গেছেন তাদের গল্পে,তাদের কাহিনীতে। সেই সব গল্প এবং কাহিনী পড়েই আমরা মানুষের অন্তর্লোকের পরিচয় জানতে পারি। সাহিত্য পাঠ,মহাপুরুষদের জীবনী ও বাণী জীবনীসাহিত্য আমাদের জীবন পথের পাথেয় স্বরূপ। দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ণয়ে ,আদর্শ স্থাপনে ,চরিত্র গঠনে এবং শোকের সান্ত্ববনায় এই ধরনের গ্রন্থগুলি আমাদের জীবনে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে। সাহিত্য পাঠে নিঃসঙ্গতা দূর হয়!বিনোদনের আনন্দ লাভ হয়।অবসর সময় অতিবাহিত করার ক্ষেত্রে সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থের মত সঙ্গী আর হয় না।কবিতা,গল্প,উপন্যাস,প্রবন্ধ,রম্য রচনা,ভ্রমন কাহিনী প্রভৃতি পাঠ করে আমরা যে অনাবিল আনন্দ লাভ করি তার তুলনা আর কিছুতে নেই। “একটি ভালো উপন্যাস আমাদের সামনে নায়ক সম্পর্কে সত্য তুলে ধরে কিন্তু বাজে উপন্যাস লেখক সম্পর্কে সত্য তুলে ধরে” A good novel tells us the truth about its hero; but a bad novel tells us the truth about its author. জি কে চেস্টারটন (Gilbert Keith Chesterton) “নিজের নিকৃষ্ট কালে চিরশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্য রয়েছে বই; আর সমকালের নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে রয়েছে টেলিভিশন ও সংবাদপত্র” হুমায়ুন আজাদ পার্থিব উন্নতির জন্য বিজ্ঞান চর্চা ও বিজ্ঞানের উন্নতি অবশ্যই প্রয়োজন,কিন্তু মানসিক উন্নতির জন্য,মানসিক তৃপ্তির জন্য সাহিত্য চর্চাকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেম আমাদের তথ্য সংগ্রহ করার সুযোগ করে দিয়েছে, অনেক কিছু শেখায়-দেখায়! আসুন যতোসব ভালো কিছু লালন করতে শিখি,মন্দ সব বর্জন করি।

লেখকঃ শওকত আখঞ্জী, উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি