সব
এখন যেটি সিলেট নগরী, একসময় এর পুরোটাই ছিলো সিলেট সদর উপজেলার অন্তর্গত। তবে নগর রূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর উপজেলার সাথে সিলেট নগরীর সে যোগসূত্র তা ঘুচে গেছে। সিলেট সদর উপজেলা এখন শুধু সিলেট নগরীর প্রতিবেশী জনপদ। এর বাইরে নগরের সাথে আর কোনো যোগ নেই সদর উপজেলার। তবে ঈদ উল আজহা বা কোনো বাণিজ্যের উপলক্ষ্য এলে উপজেলাটি নগরবাসীর আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। কোরবানির পশুর হাট নিয়ে প্রতিবছরই নগরের একেবারে নাকের ডগায় চলে আসে উপজেলার কার্যক্রম। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। ৮টি ইউনিয়নে খোলা জায়গার অভাব নেই, আছে বেশ কটি স্থায়ী হাটও, কিন্তু এসবে যেনো মন ভরে না সদর উপজেলার। নগরের কাছে ভিড়তে না পারলে যে ‘বাণিজ্য’হবে না। হাট নিয়ে সেজন্যেই নগরীর উপকণ্ঠে চলে আসা। এতে অন্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হলেও সে বিষয়ে গা নেই উপজেলা পরিষদের। স্থানীয়দের আপত্তি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুরোধ কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেট সদর উপজেলায় বাড়তি হাটের প্রয়োজনই নেই। ৮ ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি স্থায়ী হাট রয়েছে। আর ঈদকে সামনে রেখে ছোটখাটো কয়েকটি হাটও বসে। কোরবানির ঈদে উপজেলায় পশুর চাহিদা মেটাতে এ হাটগুলোই যথেষ্ট। সিলেট সদর উপজেলার মোগলগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সচিব নিহারজিৎ পাল জানালেন, হাট বসাতে কারো আগ্রহ না থাকায় তার ইউনিয়নে হাট বসে না। তিনি জানালেন, এ ইউনিয়নের লোকজন পাশের লামাকাজি থেকেই কোরবানির পশু কিনে থাকেন।
হাটখোলা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. আফতাব উদ্দিন জানালেন, শিবের বাজারে স্থায়ী পশুর হাট রয়েছে, তাই এই ইউনিয়নে আর হাট বসানোর প্রয়োজন পড়েনি। ঈদকে সামনে রেখে খাদিমনগর ইউনিয়নে দুটি পশুর হাট বসছে এর মধ্যে একটি সাহেবের বাজারের স্থায়ী হাট অপরটি ধোপাগুলে অস্থায়ী হাট। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইউনিয়ন পরিষদের তপন মজুমদার। জালালাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব রাজিব দাস জানান, কুড়িরগাঁওয়ে প্রতি বছর হাট বসে, এবার বন্যার কারণে হয়তো হাট নাও বসতে পারে। তিনি জানান, শিবেরবাজারের হাট থেকে স্থানীয়রা প্রয়োজনীয় পশু কিনে নেন। কান্দিগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সচিব তোফায়েল হোসেন ভূঁইয়া জানালেন, তার ইউনিয়নে কোনো হাট বসে না। প্রয়োজনীয় পশু তারা আশপাশের হাট থেকে কিনে নেন। খাদিমপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. আবদুল খালেক জানালেন, তার ইউনিয়নে কোনো হাট বসবে না। আশপাশের হাট থেকে তারা পশু কিনে নেবেন। টুলটিকর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব শীর্ষেন্দু বিকাশও এমনটাই জানালেন। উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে প্রতিবছর যে হাট বসানো হয় তা উপজেলার একেবারে প্রান্তে হওয়ায় উপজেলার বাসিন্দাদের আনাগোনা এতে কমই থাকে। এ হাট বসানো হয় মূলত নগরীর বাসিন্দাদের টার্গেট করেই। হাট ইজারাও নেন নগরের প্রভাবশালী বাসিন্দারাই। টুকেরবাজার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য গিয়াসউদ্দিন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের সিদ্ধান্ত ছিলো ইউনিয়নের ভেতরে কোনো হাট বসানো হবে না। কিন্তু এখন শুনতে পাচ্ছি লাক্কাতুরায় হাট বসছে।
সদর উপজেলার এবারের হাটটি ২১ লাখ টাকায় ইজারা পেয়েছে মেসার্স রুবেল এন্টারপ্রাইজ। যার স্বত্বাধিকারী যুবলীগ নেতা রুবেল আহমদ। তবে পেছনে আছেন আওয়ামী লীগের আরো কিছু নেতা এবং সিলেটের আলোচিত ‘মেলা বাবলু’। বাণিজ্যমেলা, শিল্প মেলা, কনসার্ট, পশুর হাট যেখানেই কাচা টাকার আনাগোনা সেখানেই পুঁজি খাটান এম এ মঈন খান বাবলু। বাবলুর জন্য ‘লীগ’ বা ‘দল’ কোনো পরিচয়ই লাগে না। দলীয় বা অন্য পরিচয়ের বাইরে ‘টাকার পরিচয়ে’ তিনি সবখানে মাথা ঢুকানোর সুযোগ পান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লাক্কাতুরায় যতবারই সিলেট সদর উপজেলার উদ্যোগে পশুর হাট বসেছে ততবারই একটি প্রতিষ্ঠানই এর ইজারা পেয়েছে। এবার ইজারায় ৪ জন দরদাতা থাকলেও শিকে ছিঁড়েছে সেই পুরনো ইজারাদারের ভাগ্যে। এনিয়ে অনেকের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
সিলেট নগরীর সীমানাছোঁয়া লাক্কাতুরায় হাটটি বসছে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের নাকের ডগায়। হাট জমে উঠলে সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের প্রবেশপথ, সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ, ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট পুরোটাই চলে যাবে গরুর দখলে। স্কুলের মাঠ, স্টেডিয়ামের পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতির এই সময়ে স্থানীয় জনজীবনকেও ঝুঁকির মুখে ফেলবে। চা-জনগোষ্ঠীর সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পক্ষে এমনিতেই যেখানে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা কষ্টকর সেখানে পশুর হাট পরিস্থিতি আরো ঝুঁকির মুখে ফেলবে বলেই সংশ্লিষ্টদের শঙ্কা। স্থানীয়রা তাই আপত্তি জানিয়েছেন। তবে সামাজিক ‘প্রভাবহীন’ এ জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদটি প্রভাবশালীদের কাছে ধোপে টেকেনি। প্রতিবাদ জানিয়েছে সিলেট ন্যাশনাল টি কোম্পানিও। চা বাগান ও চা শ্রমিকদের ক্ষতির আশঙ্কায় হাট না বসাতে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সিলেটের জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক আশরাফুল মতিন চৌধুরী।
লাক্কাতুরার একেবারে সীমানালাগোয়া অবস্থান সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৬ নং ওয়ার্ডের। এ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরহাদ চৌধুরী শামীম করোনার এই সময়ে লাক্কাতুরায় হাট বসানোর পক্ষপাতী নন। তিনি বলেন, বাগান এলাকার বাসিন্দাদের পাশাপাশি তার ওয়ার্ডের বাসিন্দাদেরও ঝুঁকির মুখে ফেলবে এই হাট। অনেকেই তার কাছে এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন বলে জানান ফরহাদ শামীম। তিনি মনে করেন এ হাটের ফলে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম ও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিবেশও ক্ষতির মুখে পড়বে।
সিলেট সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মহুয়া মমতাজ জানান, হাটের বিষয়ে আপত্তির ব্যাপারে তার কিছু জানা নেই। তার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। জেলা প্রশাসন থেকেও এ ব্যাপারে তাকে কিছু জানানো হয়নি।
সূত্রঃ দৈনিক একাত্তরের কথা
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি