সব
কুলাউড়া রেলওয়ে জংশনের উত্তর ও দক্ষিণ কলোনিতে পরিত্যক্ত প্রায় দেড় শতাধিক কোয়ার্টার অবৈধভাবে ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। এতে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব কোয়ার্টারে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দেয়া হয়েছে। রান্নার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বৈদ্যুতিক হিটার। কোয়ার্টার ভাড়া, বিদ্যুৎ ও পানির বিলের নামে চক্রটি প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে আত্মসাত করছে।
সরজমিনে দেখা যায়, শতাধিক বাসায় অবৈধ বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ এবং বৈদ্যুতিক হিটার ব্যবহারে অতিরিক্ত লোড পড়ে স্টেশন এলাকায় স্থাপিত বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের ওপর। অতিরিক্ত চাপে ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর ট্রান্সফরমারটি বিকল হলে তিনদিন বিদ্যুৎহীন ছিল সম্পূর্ণ স্টেশন এলাকা। অবৈধভাবে দখল করা রেলওয়ে কোয়ার্টারগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগের ফলে প্রতিটি ঘরে বৈদ্যুতিক হিটার ও চুলা ব্যবহার হচ্ছে। কুলাউড়া রেলওয়ে জংশনের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত অসাধু কর্মকর্তারা এ খাত থেকে নিয়মিত মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। ফলে প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা রাজস্ব হারাচ্ছেন সরকার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কুলাউড়া রেলওয়ে শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম, লাইনম্যান রিয়াজুর রহমান খোকন, জহির মিয়া ও খলিলুর রহমানের যোগসাজসে ভাড়ার টাকা উত্তোলন করা হয়। এদের সমন্বয় করেন কুলাউড়া জংশন স্টেশনে কর্মরত রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (ওয়ার্কস) জুয়েল হোসেন।
রেলওয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ওই চক্র মাসে লাখ টাকারও বেশি বিদ্যুৎ বিল উত্তোলন করে। এ টাকার একটি বড় অংশ জুয়েল হোসাইনসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার পকেটে যায়। তাছাড়া খালি কোয়ার্টারগুলোও ভাড়া দেয় চক্রটি। শতাধিক পরিত্যক্ত কোয়ার্টারের প্রতিটির মাসিক ভাড়া কমপক্ষে দুই হাজার টাকা। এসব অবৈধ বাসায় চলে রাত-বিরাতে মদ, জুয়া, পতিতা বৃত্তিসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপ। রেস্ট হাউসের অস্থায়ী স্টাফ টিটুর মাধ্যমে ভাড়া বাবদ মাসে এসব বাসা থেকে দু’লক্ষাধিক টাকা উত্তোলন করা হয়। মাস শেষে আয়কৃত টাকা থেকে একটি ভাগ চলে যায় কুলাউড়া রেলওয়ে জংশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার পকেটে। আর তাই তারা এসব জেনেও না জানার ভান করেন।
আলাপকালে কুলাউড়ার পরিত্যক্ত রেলওয়ে স্টেশনের উত্তর ও দক্ষিণ কলোনীর বাসিন্দা রনি মিয়া, জাহানারা বেগম, রহিমা বেগম, সীমা বেগম, বদরুল হোসেন বৈধভাবে আছেন দাবি করে বলেন, প্রতিমাসে জহির মিয়া ও রিয়াজুর রহমান খোকনের কাছে মাসিক ৫শ’ টাকা করে বিদ্যুৎ বিল দেই। আগে আব্দুর রহিম এই বিল উত্তোলন করতেন।
সূত্র আরও জানায়, পরিত্যক্ত প্রায় শতাধিক কোয়ার্টারে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করে বৈদ্যুতিক হিটার জ্বালানো হয়। এ থেকে মাসে আসছে লক্ষাধিক টাকা। এই টাকা আদায় করেন ইলেকট্রিক লাইনম্যান রিয়াজুল। অথচ প্রতি মাসে সরকারি কোষাগার থেকে কুলাউড়া স্টেশনে বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার টাকা বিল ভর্তুকি দেয়া হয়। করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ার আগে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন একটি প্রতিনিধি দল কুলাউড়া স্টেশন পরিদর্শনে এলে রেলওয়ের অবৈধ বৈদ্যুুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু সেই বিচ্ছিন্ন সংযোগ পুনরায় দিতে গ্রাহকদের কাছে ফের অর্থ দাবি করেন লাইনম্যান রিয়াজুল। এতে পরিত্যক্ত কোয়ার্টারের ক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের হামলার শিকারও হয়েছিলেন তিনি। বিষয়টি জেনেও কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কুলাউড়া স্টেশনের পানির ট্যাঙ্ক থেকে রেলস্টেশনের বিভিন্ন দোকানে ও পরিত্যক্ত বাসায় টাকার বিনিময়ে দেয়া হয়েছে অবৈধ পানি সংযোগের লাইন। অথচ স্টেশনের বাথরুমে সংযোগ না থাকায় যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হয় প্রতিনিয়ত।
রেলওয়ের একাধিক সূত্র জানায়, ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (ওয়ার্কস) জুয়েল হোসেন কুলাউড়া জংশন স্টেশনে নিজের আধিপত্যের জন্য ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের যোগসাজশে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন। এই সিন্ডিকেটের সহায়তায় নির্বিঘেœ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
কুলাউড়া রেলওয়ে শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এসবের সাথে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই। একটি বিশেষ মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব অভিযোগ তুলে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে।
উপসহকারী প্রকৌশলী (আইডাব্লিউ) মো. জুয়েল হোসাইন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন এলাকায় ২৫০টির মতো কোয়ার্টারের মধ্যে প্রায় ১৫০টি বরাদ্দ দেয়া। বাকি একশ’টি কে বা কারা ব্যবহার করছে আমি জানি না। তিনি বলেন, আমি বাসা বাড়ি মেরামতের দায়িত্বে আছি। ভাড়া দেয়ার বিষয়টি আমার কাজ নয়। যদি অবৈধভাবে কেউ কোয়ার্টার ভাড়া দিয়ে থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিদ্যুতের বিষয় দেখা আমার দায়িত্ব নয়। বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন তা দেখে থাকেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামানের (০১৭১১-৫০৫৩৮৩) কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় জেনে, পরে কথা বলবেন বলে লাইন কেটে দেন।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) প্রকৌশলী মো. আবদুল হাই জানান, রেলের জায়গায় যেসব অবৈধ বস্তি ও কোয়ার্টার রয়েছে, সেগুলো উচ্ছেদের কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে চলছে। তাছাড়া অবৈধভাবে যারা বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছেন এবং নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি