যন্ত্রণার নাম লাইভ: এরা কারা?

চৌধুরী মুমতাজ আহমদ;
  • প্রকাশিত: ১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ৮:৩০ অপরাহ্ণ | আপডেট: ৪ বছর আগে

গালিভার্স ট্রাভেলসখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক জোনাথন সুইফট বেঁচে থাকলে দেখতে পেতেন তার উক্তির চেয়েও মিথ্যে এখন কয়েকগুণ গতি পেয়েছে। তিনি বলেছিলেন, সত্য যখন তার জুতোর ফিতে বাঁধতে শুরু করে মিথ্যে তখন অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে আসে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে এখন সত্য তার জুতোর ফিতেয় হাত দিতে না দিতেই মিথ্যে পুরো পৃথিবীকে দশ পাক ঘুরে আসে। মিথ্যের এই দুরন্ত গতিকে আরও বেগবান করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সস্তা জনপ্রিয়তা আর প্রচার পেতে যাচাই না করেই বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জনপ্রিয়তা আর প্রচারের সেই মোহ যখন বাড়তে থাকে তখন তারা বেরিয়ে পড়ছেন রাস্তায়। ছোট-খাট ঘটনা, দুর্ঘটনা, বীভৎস দৃশ্য কিছুই বাদ পড়ছে না। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধরে সরাসরি প্রচার করছেন নিজেদের ফেসবুকে। লাইভ নামের এ যন্ত্রণায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা হয়ে উঠছেন অতিষ্ঠ। এদের উৎপাতে বিব্রত প্রকৃত সাংবাদিকরা, লাইভচর্চা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকেও। লাইভের আরো একটি ধরনেও ‘বিরক্ত’ যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা। নিজের পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকলেও দু’একজন অতিথি এনে বিভিন্ন বিষয়ে ‘টক শো’র আসর বসাচ্ছেন। তারা হয়তো বুঝছেনই না যে বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছেন তারা।
এক সময় ফেসবুকে ‘সেলফি’র দাপট ছিলো। তখন সেলফির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ছিলেন ব্যবহারকারীরা। এখন ফেসবুক দখলে রেখেছেন ‘লাইভ’ চর্চাকারীরা। লাইভ প্রচারকারীরা এমনভাবে প্রচারণা চালান দেখে মনে হয় বিষয়টি তারা জনস্বার্থে করছেন। তবে এর সাথে যে তাদের লাভালাভের বিষয় আছে সেটি ধরা দিতে চান না। ভিডিও’র ব্যাপক প্রচারের ফলে অনলাইন থেকে আয়ের পাশাপাশি সাংবাদিক পরিচয়েও প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন। সাংবাদিকতা পেশার প্রতি অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে। সাংবাদিক হিসেবে আলাদা একটি সামাজিক পরিচিতি জুটিয়ে নিতে তারা ফেসবুকের এ ‘শর্টকাট’ কৌশলটি বেছে নেন। সাংবাদিক হিসেবে যে নীতি নৈতিকতার পরিচয় দিতে হয় তাদের সে জ্ঞান না থাকায় প্রকৃত সাংবাদিকদের তারা বিব্রত করছেন। অনেকেই এখন মজা করে বলেন, কাকের চেয়ে সাংবাদিকের সংখ্যা বেশি। সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারীরাই শুধু নয় সমাজের প্রতিষ্ঠিত এবং প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিরাও এদেরকে সাংবাদিক ভেবে ভুল করে থাকেন। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তথাকথিত ‘লাইভ শো’তে হাজির হন। মূলত যারা একটু প্রচারপ্রিয় তারা এ সকল লাইভওয়ালাদের ফাঁদে পা দেন। আর এ সুযোগে এসকল লাইভওয়ালারা নিজেদের সাংবাদিক পরিচয়টি আরেকটু পাকাপোক্ত করে নেওয়ার চেষ্টা করে। লাইভওয়ালারা তো এটাই চান। এ পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রভাব খাটান।
লাইভের এ যন্ত্রণা চরম আকার ধারণ করে এই করোনাকালে। বিশেষ করে প্রথম দিকে মানুষ যখন ঘরবন্দি তখন সেটিকেই সুযোগ হিসেবে বেছে নেন লাইভওয়ালারা। ঘরে থাকা মানুষের তখন কেবল খবরের দিকেই আগ্রহ ছিলো। সে আগ্রহটিকে পুঁজি করে মোবাইল ফোন নিয়ে মাঠে নামেন লাইভ প্রচারকারীরা। প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয়, নৈতিক, অনৈতিক যেখানে যাই চোখে পড়েছে মোবাইলের ক্যামেরায় তুলে প্রচার করতে থাকেন। কোনটা প্রচার করা উচিত, কোনটা উচিত নয় সে জ্ঞান ছাড়াই তারা মাঠে দাপাদাপি করতে শুরু করেন। কেউ কেউ তো আরো এক কাঠি উপরে। সাংবাদিকতার কোনো জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না থাকলেও টিভি নাম দিয়ে স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম ইউটিউবেও চ্যানেল খুলেও এসব প্রচার করছেন। কোথাও একটা ঘটনা ঘটলে মোবাইল হাতে এমন অসংখ্য লাইভচর্চাকারীদের উপস্থিত হতে দেখা যায়। করোনার সময়ে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে বারবার সামাজিক দূরত্ব রক্ষার তাগিদ দেওয়া হলেও মোবাইল ক্যামেরাওয়ালাদের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সেটি সম্ভব হয় না। কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনার পর মোবাইল-মাউথপিস নিয়ে ছুঠে যাওয়া এসব লাইভওয়ালা’রা ভিকটিমদেরও বিব্রত করছেন, ব্যাঘাত  ঘটান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও। সস্তা জনপ্রিয়তা, অনলাইন আয়ের মোহে তারা সাংবাদিকতা পেশাকে বিব্রতকর করে তুলছেন। সাংবাদিকতার জ্ঞান না থাকা এসব ফেসবুক অ্যাক্টিভিস্টরা সমাজেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছেন। নানা বিষয়ে উসকানি দিয়ে অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টিতে এরাই সবচেয়ে এগিয়ে।
লাইভ যন্ত্রণা যে সরকারকেও ভাবাচ্ছে সেটা টের পাওয়া গেছে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাসিক সমন্বয় সভায়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ইন্টারনেট নির্ভর টিভি চালাতে নিবন্ধন লাগবে। অপর দিকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় মন্ত্রণালয়ের ‘সোশ্যাল অ্যান্ড নিউ মিডিয়া উইং’ গঠন করবে তথ্য মন্ত্রণালয়।
তবে যদি কিছুটা বোধোদয় ঘটে লাইভওয়ালাদের।

সূত্র- দৈনিক একাত্তরের কথা

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি