মুজিব চেতনার ধারক শেখ তজমুল আলী চেয়ারম্যান

এফ এইচ ফারহান;
  • প্রকাশিত: ২৩ জুলাই ২০২০, ১২:৫৪ অপরাহ্ণ | আপডেট: ৫ বছর আগে

স্বাধীনতা ও মুজিব। চেতনার আকাশে জ্বলজ্বলে এ দুটো শব্দতেই যেন পূর্ণতা পায় বাংলাদেশ। ছেষট্টির মুক্তির সনদ ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ− সবই একই সূত্রে গাথা। মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীর মুক্তির তৃপ্তি লাভে যে রাজনৈতিক সংগঠনটির কথা না বললেই নয়, সেটি হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শের অন্যতম প্রতিফলক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং স্বাধীন বাংলা পুনর্নির্মাণে দেশের প্রত্যন্ত অ লে নেতৃত্ব দানকারী নেতারাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আস্থা অর্জনকারী তৃণমূল আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি। দুর্যোগে-সংকটে সেই ত্যাগী নেতাদের ধরে রাখা দৃঢ় মনোবল, মুজিব আদর্শ কিংবা মানুষের জন্য বাঁচা, তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতারা এরূপ শত গুণে গুণান্বিত ছিলেন। এমনই একজন নেতা মরহুম শেখ তজমুল আলী চেয়ারম্যান।
ষাট থেকে নব্বই দশকের রাজনীতিতে শাহজালালের পুণ্যভূমি খ্যাত সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা থেকে বেড়ে ওঠা অন্যতম এক সাংগঠনিক কৌশলী ও আদর্শের রাজনীতিতে ঋদ্ধ তজমুল আলী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন । সর্বজনস্বীকৃত এই আওয়ামী লীগ নেতা ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত সৎ, পরিশ্রমী এবং ন্যায়-নীতির মূর্ত প্রতীক ছিলেন। কিশোর তজমুল ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তার যোগ্যতার জোরে সরাসরি ফে ুগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে মনোনীত হন। তারুণ্যে ভরপুর এই রাজনৈতিক সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের পথপ্রদর্শক।


৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০। তৃণমূলের রাজনীতি থেকে বেড়ে ওঠা এই গণমানুষের নেতা মাইজগাঁও স্টেশনের এক বিশাল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে মানপত্র পাঠ করে শুনান। ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লিখা পত্রে শেখ তজমুল আলী বিস্তারিত বিবরণীসহ মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সেই স্বর্ণালী মুহূর্তগুলোকে স্মরণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু তজমুল আলীকে জনসম্মুখে ডেকে নিয়ে তার মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন এবং সকলের সামনে তার হাত তুলে বলেন- তজমুল আলী আমার আদর্শকে ধারণ করে, সে একদিন জাতীয় নেতা হবে। বঙ্গবন্ধু যে রত্ন চিনতে ভুল করেননি, সেটা পরে প্রমাণ করেছেন তজমুল আলী। বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদধন্য সেই তজমুল আলী মুজিব বাহিনীর অন্যতম একজন সদস্য হিসেবে স্বাধীন বাংলা গঠন এবং বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে শেখ তজমুল আলী ফেঞ্চুগঞ্জ সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক মনোনীত হন এবং প্রথম সারির নেতা হিসেবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বহুবার তজমুল আলীর বাড়ি আক্রমণ করে এবং পুড়িয়ে দেয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরির আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও ফে ুগঞ্জ থানা সমন্বিত আসনে আতাউল গণি ওসমানী এবং প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ফেঞ্চুগঞ্জ -বালাগঞ্জ আসন থেকে অ্যাডভোকেট লুৎফুর রহমান আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হলে ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে তাদের পক্ষে জোর প্রচারণা চালান তজমুল আলী।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তজমুল আলী নিজেও নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছিলেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলার প্রথম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তজমুল আলী বিপুল ভোটে মাইজগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন, যেখানে তৎকালীন সময়ের চেয়ারম্যান অপেক্ষা তিনি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী ভোট পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অর্জিত তার সেই জনপ্রিয়তা সকলকে অবাক করে দেয়। স্বাধীন বাংলা ছাত্রলীগ ফে ুগঞ্জ উপজেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন রতনের ভাষ্যমতে, তজমুল আলীর জনপ্রিয়তা এতটাই আকাশচুম্বী ছিলো, তিনি ফেঞ্চুগঞ্জের যেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন, লোকজন বলে ওঠতো এই যায় আমাদের বাঘ। তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান মো. সজ্জাদ আলী চেীধুরী বলেছিলেন, আমার ভাই তজমুল আলী যতদিন ইউনিয়ন পরিষদে যাবেন, ততদিন আমি বিশ্রামে থাকলেও চলবে। তজমুল আলীর কর্মক্ষমতা সম্পর্কে আমি অবগত।
একই বছর মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী ফেঞ্চুগঞ্জ নেমেই তজমুল আলীর তলব করেন। ‘আমি তজমুল কে দেখছিনা, খবর দাও’ বলে ডেকে নিয়ে সাক্ষাৎ করেন।
তজমুল আলী স্বাধীন বাংলার প্রথম দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে ফেঞ্চুগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের প্রথম সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরপর তিনবার একই দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। ১৯৭৩ সালের স্বাধীন বাংলার প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেওয়ান ফরিদ গাজী সিলেট সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, সেসময় তিনি তজমুল আলীকে ছোট ভাই আখ্যায়িত করে একান্ত ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানী ফে ুগঞ্জে এলে স্থানীয় কিছু লোককে সারকারখানায় কোটাভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার দাবি তুলেন শেখ তজমুল আলী। এতে জেনারেল ওসমানীর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় তজমুল আলীর মাধ্যমে সর্বপ্রথম পাঁচজন স্থানীয় লোকের চাকুরি হয়। এছাড়াও তজমুল আলীর দাবির প্রেক্ষিতেই ফে ুগঞ্জস্থ কচুয়াবহর, মির্জাপুর, পানিসাইল, মাইজগাঁও, চেলারচক, বকশিপুর, বারহাল, শিমুলতলা, কর্মদা ও নিজামপুর গ্রামকে সারকারখানার নির্গত দুষিত বর্জ্য গ্যাসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিহ্নিত করে ও দুর্গত চিলুয়া বিল হাওরকে ফসলি ও জমির পরিমাণে নির্দিষ্ট হারে প্রথম বারের মতো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়।
১৯৭৪ সালে তজমুল আলী ফেঞ্চুগঞ্জ থানা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত সততা এবং নিষ্ঠার সাথে প্রতিটি দায়িত্ব পালন করেন। ন্যায়পরায়ণতার স্বীকৃতিস্বরূপ তজমুল আলী প্রারম্ভিক অবস্থা থেকেই সিলেটব্যাপী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেন। ৭৪’র মাঝামাঝি সময়ে দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে দুর্ভিক্ষ নিরসনে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তৎকালীন সামরিক সরকারের সকল ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তজমুল আলী ফেঞ্চুগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের প্রথম সভা আহবান করেন। সকল বাধা উপেক্ষা করে তিনি প্রতিবাদ করেন এবং জনসম্মুখে মিলাদ মাহফিল পড়ান। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করে দলকে এগিয়ে নেওয়ায় তিনি তৎকালীন সামরিকশাসিত সরকার কর্তৃক বিভিন্নভাবে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন। সান্ধ্য আইন ভেঙে তজমুল আলীর নেতৃত্বে তার সবচেয়ে কাছের মানুষ ডা. মিনহাজ উদ্দিন, আব্দুল লতিফ, অ্যাডভোকেট অমলেন্দু, আব্দুর রশিদ (ফিজিক্যল স্যার), নাসির উদ্দিন রতন, সামসুদ্দিন কুমীসহ অনেকেই জয় বাংলা শ্লোগান তুলে মোস্তাক সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। উত্তপ্ত ফেঞ্চুগঞ্জের সেই প্রতিবাদের ভাষা অনুপ্রাণিত করেছিল বঙ্গবন্ধুপ্রেমী সকল কৃষক-শ্রমিক মানুষকেও। ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী বাকশাল গঠন করার প্রস্তাবনা থাকলে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় অন্যতম সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন শেখ তজমুল আলী। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেটা কার্যকর হয়নি।
১৯৭৭ সালে তজমুল আলী পুনরায় ইউপি মেম্বার নির্বাচিত হন এবং এলাকার উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষিত অভিনন্দন পত্র গ্রহণ করেন। সাধারণ জনতার আশা আকাক্সক্ষার বাস্তব প্রতিফলনের ধারক এবং বাহক ছিলেন তজমুল আলী। আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় ১৯৭৯ সালের ১৩ জুলাই তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দলপতি পত্র (সম্মাননা স্মারক) গ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ আব্দুল লতিফকে তিনি এতটাই সম্মান করতেন ও শ্রদ্ধা করতেন যে, তিনি তখনই সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব আব্দুল লতিফের উপর অর্পণ করে পুনরায় প্রথম সাংগঠনিক পদ গ্রহণ করেন। এলাকার উন্নয়নকল্পে তখন তিনি আলাদা প্রজেক্ট কমিটি গঠন করে সেটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে বিএনপির জয় জয়কার হলেও ফে ুগঞ্জ-বালাগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইনামুল হক চৌধুরী (বীর প্রতীক) ৩ হাজার ৫৭৩ ভোটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থী ফতেহ ইউনুছ খানকে হারিয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন। আওয়ামীলীগ প্রার্থীকে বিজয়ী করতে তজমুল আলী, আব্দুল লতিফ, ডা. মিনহাজ উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. নুরুল হোসেন চ ল, তৎকালীন সারকারখানা স্কুল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বাছিত টুটুল সহ অনেকেই দিনরাত পরিশ্রম করেন।
১৯৮০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তজমুল আলী ফেঞ্চুগঞ্জ থানা শ্রমিকলীগের যুগ্ম আহবায়ক ও একইসাথে ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা শ্রমিকলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সারকারখানা শ্রমিকদের দাবি আদায়ে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৮৩ সালের ২ জুলাই আ লিক সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল এম এ সামাদ ফেঞ্চুগঞ্জ এলে তিনি ফে ুগঞ্জ আওয়ামী লীগ সহ এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বৃহত্তম হাকালুকি হাওর তীরবর্তী লাখ লাখ একর জমির ফসল রক্ষায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প গ্রহণ, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার রক্ষা প্রকল্প, এশিয়ান হাইওয়ের সাথে পাকা রাস্তার মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন এবং ফে ুগঞ্জ থানার একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফেঞ্চুগঞ্জ ডিগ্রী কলেজকে সরকারিকরণের দাবি জানান।
সর্বদলের কাছে সম্মানের পাত্র এই জননেতা ১৯৮৪ সালে সিলেট সদর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে গ্রুপভিত্তিক রাজনীতি অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় তজমুল আলী সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলারদের সম্মতিক্রমে সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেন। সংখ্যাগরিষ্ঠদের এমন দাবির প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই গঠনতন্ত্রবিরোধী কমিটি বাতিল করেন। তৎকালীন সময়ে তজমুল আলী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সিলেট বিভাগব্যাপী তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে জোর ভূমিকা পালন করেন এবং জেলা আওয়ামী লীগ এডহক কমিটি সমূহে অন্যতম সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮৯ সালের ১১ই এপ্রিল তজমুল আলী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রাকৃতিক গ্যাস সারকারখানা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। সেই সময় তিনি থানা কাউন্সিলারের প্রধান দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক তৃণমূল আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন ও দলকে সুন্দর একটি গাঠনিক রূপ দেয়ার স্বার্থে ২নং মাইজগাঁও আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। সেসময় তিনি স্বেচ্ছায় সাংগঠনিক পদ ছেড়ে দিয়ে মাইজগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯১ পরবর্তী সময়ে তজমুল আলী ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা গণদাবী পরিষদ গঠন করে যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং সারকারখানা রক্ষা আন্দোলনে রাজপথ দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। যেখানে ডা. মিনহাজ উদ্দিন, জমির উদ্দিন, লুৎফুর রহমান এবং আব্দুল বারী তার ঘনিষ্ট পরিকল্পনা সঙ্গী ছিলেন। স্বশরীরে মাঠে সক্রিয় ছিলেন সদ্য সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আতাউর রহমান চেীধুরী সেলিম। সেসময় সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয় ঝুঁকিপূর্ণ অজুহাত দিয়ে একটি সার্কুলেশনের মাধ্যমে ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা বন্ধ করার সিন্ধান্ত নিয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ সহ বৃহত্তর সিলেটের ১৮ জন সাংসদ ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা মাঠে বিশাল প্রতিবাদ সভায় জড়ো হন। প্রথম সারি থেকে নেতৃত্ব দেন তজমুল আলী। তজমুল আলীর শিশুসন্তান বর্তমান শ্রমিক নেতা দিদারুল হাসান শিহাব সেদিন ফেঞ্চুগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি মামুন আহমদ নেওয়াজের কোলে ওঠে গর্জে ওঠা জনস্রোতে যে বক্তব্য রাখেন, সেটা সকল নেতৃবৃন্দন্দের অবাক করে দেয় এবং অবশেষে ফেঞ্চুগঞ্জ বাসী সফল হন। রক্ষা পায় ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা। ১৯৯৫ সালের ১১ অক্টোবর তজমুল আলী সারকারখানায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কল্যাণ কমিটি গঠন করে সেটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শ্রমিকসমাজের কাছের নেতা তজমুল আলী সর্বপ্রথম ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় স্থানীয় শ্রমিকদের চাকরির দাবি জানান। সকল লোভ-লালসার উর্দ্ধে গিয়ে স্থানীয় শ্রমিকদের কল্যাণে তার সৎ নীতিতে অটল থাকা এবং তার আত্মত্যাগ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছিলো। তজমুল আলীর সততা, যুক্তি এবং সাহসিকতাপূর্ণ নেতৃত্ব স্থানীয় শ্রমিকদের মুগ্ধ করেছিল এবং তিনি সারকারখানা রক্ষা আন্দোলনে সফল হয়েছিলেন।

১৯৯৮ সালে যখন তিনি দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত, তখনও তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ থানা ক্রীড়া সংস্থার উপদেষ্টা এবং থানা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সব ধরণের রাজনৈতিক, সামাজিক, বিচার-শালিস ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকেন। তজমুল আলী কচুয়াবহর যুব সংঘসহ অসংখ্য সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা, উপদেষ্ঠা, সভাপতি, সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ক্রীড়াঙ্গনের মান উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি একাধিকবার ফে ুগঞ্জ থানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ সভাপতি নির্বাচিত হন। বিভিন্ন সালিশে দল মত নির্বিশেষে তজমুল আলীর দৃঢ় সিদ্ধান্ত স্থানীয় ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে আলোকিত করেছিল। তাছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নারী-শিশু-শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নে তজমুল আলী তার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করেন। ফেঞ্চুগঞ্জ ফাউন্ডেশনের ভিত্তি মজবুতকরণে বিশেষ অবদান সহ গ্রাম এলাকায় বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় নিজ গ্রাম মির্জাপুরে কচুয়াবহর-মির্জাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তজমুল আলী। স্কুলের জায়গা প্রদান করেন তার ভ্রাতা আইয়ুব আলী মেম্বার সহ এলাকার বিশিষ্টজন।
অতি অল্প সময়ে দেশের শ্রেষ্ঠ ২৪ জন চেয়ারম্যানদের অন্যতম একজন নির্বাচিত হওয়াসহ ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা বর্জ্য পদার্থ সম্পৃক্ত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনে তজমুল আলী চেয়ারম্যান অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। নিজ এলাকার পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের প্রথম ইউপি চেয়ারম্যান তিনিই, যিনি সর্বপ্রথম ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা কর্তৃপক্ষকে আপত্তিপত্র দাখিল করেন। স্বার্থান্বেষী মহল তাকে বস্তাভর্তি টাকা, গাড়ি-বাড়ি, পরিচিতজনদের সারকারখানায় চাকরি সহ নানা প্রলোভন দেখালেও তজমুল আলী তার নীতি থেকে এক চুলও নড়েননি ; যে কারণে তার মৃত্যুর ২১ বৎসর পরও নিজ দলীয়, বিরোধীদলীয় কিংবা নির্দলীয় ব্যক্তিরা তাকে আদর্শের মাইলফলক বলে আখ্যায়িত করেন।

 

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি