সব
একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের মধ্যেও অনেকে চিকিৎসার প্রয়োজন হলে দেশের বাইরে চলে যেতেন। জায়গা জমি বিক্রি করে মানুষ বিদেশে থাকা-খাওয়াসহ চিকিৎসার টাকা জোগাড় করেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে অহরহ। কিন্তু গত দশ পনেরো বছরে দেশের বেসরকারি চিকিৎসা সেবা খাতে কিছুটা দাঁড়িয়ে যাওয়ায় এই অবস্থা বদলাতে শুরু করেছিল। যখন বাংলাদেশে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে গেল, যখন সাধারণ জনগণের এই খাতে আস্থা গড়ে উঠলো এবং অল্প কিছু বিনিয়োগকারী স্বাস্থ্য-ক্ষেত্রে বিনিয়োগে এগিয়ে আসলেন, ঠিক তখনই দেখা গেল বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু হল। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই খাতে দুর্নীতি অনিয়ম করেছে, এটা সত্য। কিন্তু দেখা গেল, ঢালাওভাবে সমস্ত হাসপাতালকে দোষারোপ করা শুরু হল।
বেসরকারি খাতে অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই বলা চলে মোটামুটি নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। যেমন- আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্কয়ার, ল্যাব এইড, পপুলার ইত্যাদি। আর বারডেম আমাদের দেশে বহু বছর ধরেই চিকিৎসা খাতে একটা আস্থার জায়গা হয়ে আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, পত্রপত্রিকায় দেখলাম বারডেম থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত হাসপাতালই তাদের রেজিস্ট্রেশন নবায়ন করতে পারছে না। এই রেজিস্ট্রেশন নেওয়া এবং নবায়নের নিয়ম কানুন এমনভাবে করা হয়েছে যে, সহজে কেউ এটা পাওয়ার যোগ্য হতে পারবে না। এমনটা হলে নতুন কেউ তো স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করতে আসবেই না, উল্টো যারা আছে তারাও আস্তে আস্তে নিজেদের গুটিয়ে ফেলবে।
যদি বসুন্ধরা গ্রুপ, যমুনা গ্রুপসহ আমাদের দেশের বড় বড় শিল্প-গ্রুপগুলো স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ করত তাহলে এই খাতের চেহারাটাই পাল্টে যেত। করোনা চিকিৎসায় বসুন্ধরা কিছুটা এগিয়ে আসলেও বড় আকারে আসেনি। আর এখন এই খাতের যে চেহারা বেরিয়ে আসছে, তাতে অন্য কেউ যে আসবে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। এমন অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে কেবল আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোই লাভবান হবে।
বেসরকারি খাতের উপর আমাদের যেটুকু বিশ্বাস ছিল আস্তে আস্তে সেটাও ভেঙে যাবে। রোগীরা দেশে চিকিৎসা না নিয়ে ভারত, সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডের হাসপাতালে যাবে। বেশ কয়েক বছর এসব দেশের হাসপাতালের এজেন্টদের কার্যক্রম তেমন একটা নজরে পড়েনি। তারা মোটামুটি চুপচাপই ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, ভারত থেকে শুরু করে, ব্যংকক, সিঙ্গাপুরের এজেন্টরা বাংলাদেশে খুব শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তারা বিভিন্ন চিকিৎসকদের এবং সংগঠনকে দাওয়াত করে তাদের কি কি ভালো চিকিৎসাসেবা আছে, সেসব জানাচ্ছে। আমি নিশ্চিত যে, কিছুদিন পরে পত্র পত্রিকাতে এবং বিভিন্ন মিডিয়ায় বড় আকারে তাদের বিজ্ঞাপন আসবে। সেসব বিজ্ঞাপনে অ লিখিতভাবে জানানো হবে যে, বাংলাদেশে বেসরকারি হাসপাতাল বিশেষ করে বারডেমের মতো হাসপাতাল যখন রেজিস্ট্রেশনই নবায়ন করতে পারে না, তাহলে বাংলাদেশে বেসরকারি খাত কোনো চিকিৎসা দেওয়ারই যোগ্যতা রাখে না।
আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে যে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে দুর্বল করে প্রতিবেশী দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করার ফন্দি আঁটছে কিনা। আমি বিশ্বাস করি যে, অনেক কিছুই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরে সঠিকভাবে আনা হয় না এবং হচ্ছে না। বিশেষ করে, করোনা কালীন সময়ে যে কেউ ইচ্ছা করলেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন না, সেটা সম্ভব নয় এবং উচিতও নয়। এজন্য অনেক বিষয়ই হয়তো তার অজ্ঞাতেই ঘটে চলেছে।
আমি সরাসরি বলতে চাই, বর্তমানে বেসরকারি খাতের হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে যে অবস্থা চলছে, এটা এই খাতকে পঙ্গু বানাবার একটা পাঁয়তারা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে আমি কাজ করেছি। সুতরাং আমি দাবি করতে পারি যে, এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলবো যে, বেসরকারি খাত নিয়ে চলমান অচলাবস্থা কাটাতে একটা কার্যকর কমিটি করা দরকার। জাতীয় অধ্যাপক সাহালা খাতুনকে প্রধান করে তার সাথে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ- এই তিনজনকে মূল ব্যক্তি রেখে কমিটি করা যেতে পারে। একজন অতিরিক্ত সচিবকে তাদের সহায়তা এবং দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করার জন্য দেওয়া যেতে পারে।
তবে সাম্প্রতিককালে যেই কমিটিগুলো হচ্ছে তেমন কোনো কমিটি করার কথা আমি বলছি না। সম্প্রতি আমরা এমনটাও দেখেছি যে, সিনিয়র ডাক্তারদের নিয়ে কমিটি গড়ে তাদের মূল কর্তা করা হয়েছে একজন অতিরিক্ত সচিবকে। এমন কমিটির কথা আমি বলছি না। জাতীয় অধ্যাপক শাহালা খাতুন, অধ্যাপক শহীদুল্লাহ এবং এবিএম আব্দুল্লাহর মতো দেশবরেণ্য চিকিৎসকরা যেই কমিটিতে থাকবেন, তাদের মূল কর্তা হিসেবে অন্য কাউকে দরকার বলে আমি মনে করি না।
এরা তিনজন মূল ব্যক্তি হিসেবে বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলোচনা করে তাদের সুপারিশ জানাতে পারবেন। এই তিনজনের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আমি যে সময় থেকে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয় বোঝা শুরু করেছি, তখন থেকে অধ্যাপক শাহালা খাতুনের নাম জানি। তার অভিজ্ঞতা, তার সততা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার অবকাশ নেই। অধ্যাপক আব্দুল্লাহর সততা এবং নিরপেক্ষতা আকাশচুম্বি, ঠিক একই কথা বলা চলে অধ্যাপক শহীদুল্লাহর বিষয়ে। তারা তিনজন যদি বিভিন্ন লোকের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে কীভাবে আমাদের বেসরকারি খাতকে রক্ষা করা যায় এবং আইন কানুনগুলো বাস্তবসম্মত করা যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ দেন, এবং সেটা যদি প্রতিপালন করা হয়, তাহলে হয়তো স্বাস্থ্যখাতের চিত্রটাই পাল্টে যাবে। আমাদের আরও অনেক যোগ্য লোক আছেন, তাদেরও এই কমিটিতে নেওয়া যেতে পারে।
এটা বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না যে, বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স পেতে আইন কানুনগুলো সম্পূর্ণ অবাস্তব। এটা তাদের পক্ষেই পাওয়া সম্ভব যারা একটা দালাল নিয়োগ করবেন এবং বলবেন যে তোমাকে আমি ২ লাখ টাকা দিলাম, তুমি আমাকে এই সার্টিফিকেটগুলো জোগাড় করে দেবে। তারা সেভাবে কাজটা করে দেবে। এটা তো হতে পারে না। একটা দেশে আইন এমন হতে হবে, যাতে সব লোক সৎ থেকে সেটা মানতে পারে। একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি। এরশাদের সময় একটা কঠিন আইন করা হয়েছিল কোনো একটি বিষয়ে। তখন একজন আমলা বললেন, এই আইনে আমাদের সুবিধা হলো। আমি বললাম, কেন? তিনি বললেন, আগে আমরা যে কাজে ঘুষ নিতাম ১ হাজার টাকা, এখন সেখানে ২ হাজার টাকা নিতে পারবো। বলবো যে, দেখুন আইন কতো কঠিন হয়েছে, তাই টাকাও বেশি।
আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা চাচ্ছেন দেশে সবকিছু স্বচ্ছভাবে চলবে এবং অবশ্যই দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। ইতিমধ্যে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। সেই জায়গায় যদি এই বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে লাইসেন্স নবায়নের আইন কানুনগুলো এমন হয় যে আইনই অন্যায় পথের জন্ম দেবে, তাহলে তো বেসরকারি খাত এগুবে না। নতুন কোনো বিনিয়োগকারী আসবে না।
আমি দেখলাম, বেসরকারি খাতে একটি হাসপাতাল রেজিস্ট্রেশন করতে অনলাইন ফরম করা হয়েছে। সেই অনলাইন ফরম এরকম যে, একটা তথ্য এদিক ওদিক গেলে সেটা গ্রহণ করা হবে না। সেই ফরম বাস্তবভিত্তিকও নয়। এখন বারডেমের দায়িত্বে আছেন অধ্যাপক আজাদ। তিনি আমাদেরও সিনিয়র। তিনি কোনো জায়গাতে কোনো আইন অমান্য করেন না। এটা তার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। অথচ তিনিও এই হাসপাতাল রেজিস্ট্রেশনের আইন অনুসরণ করে লাইসেন্স নবায়ন করতে পারছেন না। এ থেকেই বোঝা যায় যে, এটার ভেতরে কোনো গলদ আছে। আমাদের বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যা আছে। এই সমস্যা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে, নইলে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে যাবে। আস্তে আস্তে জনগণ এর থেকে দূরে সরে যাবে।
আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমাদের দেশের বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কি আমরা এগিয়ে নিতে চাই, নাকি সারা জীবনের জন্য আমরা অন্য দেশের কাছে স্বাস্থ্য খাতকে বিক্রি করে দিতে চাই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি হাসপাতালের অনেক যন্ত্রপাতি আনার ক্ষেত্রে প্রথম ট্যাক্স মওকুফ করে ছিলেন। তিনি এই খাতকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের যাদেরকে তিনি দায়িত্ব দেন, তারা নীচে বসে ওটাকে ১৮০ ডিগ্রি উল্টো করে চালাতে চাই। বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত নিয়ে যা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে যে, দেশের বিরুদ্ধে শুধু নয়, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। জনগণের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সুতরাং এ ব্যবস্থাটা অবিলম্বে ঢেলে সাজানো দরকার। বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতকে বাঁচানো দরকার। রেজিস্ট্রেশন পেতে হলে নিয়ম অবশ্যই মানতে হবে। কিন্তু সেটার ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত নিয়ম নীতি থাকতে হবে, যাতে জনগণও সুরক্ষিত থাকে এবং যারা এই খাতে বিনিয়োগ করবেন তারাও যেন বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন।
এখন অনেককেই দেখি তারা মিডিয়ায় এসে এসব ব্যাপারে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অবাক হই এসব দেখে। দেশ তো মিডিয়া চালায় না, দেশ চালান প্রধানমন্ত্রী। দায়িত্বশীল যারা আছেন, তারা বিষয়গুলো লিখিতভাবে তাকে জানাতে পারেন। সেটা না করে অনেকেই উল্টো পথে চলছেন। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির সময়ে আমি একদম ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা হিসেবে যেকোনো বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়িয়েছি, ভয় পাইনি, কথা বলেছি। সেটারও একটা প্রক্রিয়া ছিল। অথচ এখন অনেককেই দেখি তারা মিডিয়াকে অস্ত্র বানাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলেন, আমি বিনিয়োগ সহায়ক সিস্টেম করতে চাই। এমনকি তিনি চান কোনো একজন রোগী যেন যেকোনো একটা হাসপাতালে গিয়েই সমস্ত সেবা পায়। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রী যেভাবে দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাচ্ছেন, এই প্রাইভেট মেডিকেল সেক্টরকেও সেই গতির সাথে তাল মেলাতে হবে। নেত্রীর যে আকাঙ্ক্ষা সেই পথে এগোনোর জন্য অবিলম্বে আমাদেরকে বাস্তব একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক গতি যেন আরও বাড়ে এবং দেশের টাকা যেন দেশে থাকে সেজন্য আমাদের বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত নিয়ে অবশ্যই গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিকল্প নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান।
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি