সব
ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী
আকাশ ভরা ঘনঘনে রোদ। রোদের প্রতাপ যেতে না যেতেই মেঘে মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ, প্রবল বর্ষায় ডুবতে থাকে চরাচর। বছরের এই সময়ে এভাবেই রোদ-বৃষ্টির খেলা চলে। আবহাওয়ার এই তারতম্যে শরীরকে ক্ষনে ক্ষনে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে হয়।
বর্ষা ঋতুতে খাল-বিলে জঞ্জালের পাহাড়, পথে নর্দমার কাঁদা, গর্তে জমে থাকা বৃষ্টির পানি, কখনও জমে থাকা পানিতে মশার বসতি, দূষিত পানিতে সয়লাব চারদিক- এগুলো খুবই পরিচিত দৃশ্য। এ সময় অনুজীবদের আবির্ভাব ঘটে অস্বাভাবিক হারে। শ্বাসযন্ত্রের রোগ, পেটের রোগ, ভাইরাস জাতীয় রোগ, ইত্যাদির জন্য অনুকূল পরিবেশ বর্ষাকাল। এই সময় রোগগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
তাই এই সময় নিজের ও পরিবারের সদস্যদের দিকে খেয়াল রাখতে হয় বেশি। সতর্কতার সাথে দেখ-ভাল করা চাই-ই চাই। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের অসুখ-বিসুখ হওয়ার প্রবণতা থাকে বেশি। যে কোন রোগবালাই হলে মন খারাপ থাকে, ফলে বাদল দিনের কদম ফুল দেখার আনন্দ যেমন বিলীন হয়ে যায় তেমনি প্রচন্ড গরমের পর স্বস্তির এক পশলা বৃষ্টি তখন বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বর্ষায় যেসব রোগ হতে পারে তার মধ্যে অন্যতম ফ্লু জাতীয় রোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ তথা হাপাঁনি, সিওপিডি, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া। বর্ষাকালে বার বার ভেজা, ভ্যাপসা ও ঠান্ডা আবহাওয়াতে হাপাঁনি/শ্বাসকষ্ট বাড়তেই পারে কারও কারও। বৃষ্টিতে ভিজে গায়ে কাপড় শুকালে ঠান্ডা লাগতে পারে। তাই এই সময় প্রত্যেকের উচিত ভারী কাপড় পরিহার করে হালকা-ঢিলেঢালা পোষাক পরিধান করা।
বর্ষাকালের অধিকাংশ রোগই পানিবাহিত। তাই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার গ্রহণের কারণে বর্ষাকালের এই সময়ে অনেকের হজমে গোলমাল দেখা দেয়। প্রথম বৃষ্টি যখন আসে ঘন গৌরবে তখন পেটের অসুখ, ডায়রিয়া, এমিবিয়াসিস, হেপাটাইটিস বা জন্ডিস হতে পারে। এছাড়াও আমাশয়, উদরাময়, টাইফয়েড জ্বর দেখা যায় বেশি বর্ষা মৌসুমে। দূষিত জল ও খাদ্য এসব রোগ ঘটানোর পেছনে মূল কারণ হিসাবে কাজ করে। তাই সঠিকভাবে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি পালন এসময় খুবই জরুরি।
বৃষ্টির এই সময়ে হতে পারে ত্বকের রোগ/ডার্মাটাইটিস। ছত্রাকের কারণে বেশি হয় ত্বকের রোগ। এলার্জিও হতে পারে। রাইনাইটিস, এটোপিক ডার্মাটাইটিস, নেত্রবর্ণ প্রদাহ (চোখ উঠা) দেখা যায় বর্ষাকালে বেশি। বর্ষাকাল মানেই মশার ডিম পাড়ার সময়। তাই মশাবাহিত রোগ : ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু জ্বর বর্ষার অসুখ।
তাই আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই এই বাদল দিনে/বর্ষা মৌসুমে কী করে রক্ষা করতে পারি নিজেদের?
# ফুটানো (Boiled/Filtered) পানি পান করতে হবে। বর্ষায় বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস করা উচিত। রাস্তার ধারে ফুটপাতে তৈরী ফলের জুস; লাচ্ছি, শরবত যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।
# সুষম খাদ্য, প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া; যেগুলোতে বেশি আছে ভিটামিন ‘সি’ (যেমন: পেয়ারা, কমলা, মাল্টা, আনারস)। তবে ফল ও শাকসবজি বাজার থেকে আনার পর মনে করে প্রথমেই খুব ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে, কারণ এগুলোতে জীবাণুর লার্ভা, ভাইরাস ও রাস্তার ধূলাবালি লেগে থাকে।
# নিশ্চিত করতে হবে বৃষ্টি ও ঠান্ডা থেকে নিজেকে রক্ষা করা। ছাতা ও বর্ষাতি ব্যবহার করা চাই। বৃষ্টির মধ্যে রেইনকোট পরে বেরুনো উচিত। ভেজা কাপড় বাসায় এসেই চটজলদি বদলে ফেলতে হবে।
# বৃষ্টিতে ভিজতে আপনি যতই ভালোবাসুন না কেন; এই সময়ে নিজের শরীরের যতেœর কথা চিন্তা করে এড়িয়ে চলুন বৃষ্টিতে ভেজা। আর যদি হঠাৎ করে কোনভাবে বৃষ্টিতে ভিজেও যান, তাহলে বাড়ি ফিরে সাথে সাথে হালকা কুসুম গরম জলে ¯œান করে নিবেন।
# ত্বক যতদূর সম্ভব শুকনো রাখার চেষ্টা করবেন। বর্ষাকালে ভালো ব্র্যান্ডের ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করা উচিত। পাউডার ত্বকের ছত্রাক জাতীয় রোগ প্রতিরোধ করে।
# বর্ষাকালে রাস্তাঘাট নর্দমার কাঁদা ও গর্তে জমে থাকা ময়লা পানিতে সয়লাব থাকে। আজকাল অল্প বৃষ্টিতে শহরের রাস্তাগুলো হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায়। যা হাটার সময় আমাদের গায়ে লাগে এবং জুতায় প্রবেশ করে। এই কাঁদা ও ময়লা পানি ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের বেড়ে উঠার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরী করে। তাই বাইরে থেকে আসা মাত্রই পা ভালো করে সাবান দিয়ে ধোয়ার পাশাপাশি জুতাও পরিস্কার করে শুকাতে দিতে হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের বর্ষাকালে পায়ের অতিরিক্ত যতœ নিতে হবে, ডায়াবেটিক ফুট (Diabetic foot) থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
# দূষিত জল দিয়ে জামা-কাপড়; থালা-বাসন না ধোয়াই উচিত। বাচ্চাদের এই সময় কৃমির সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশী থাকে, তাই বাচ্চাদের নোংরা পানিতে যেতে দিবেন না এবং খালি পায়ে হাটতে দিবেন না।
# মনে রাখবেন, ডেঙ্গুর মতো ভেক্টর বা মশাবাহিত রোগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য এবং নির্মূল করা প্রায় অসম্ভব। এডিস মশা ডোবা-নালায় নয়, বরং ঘরের ভেতরে বা আশেপাশে ৩ দিনের বেশি জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে বংশবিস্তার করে। সুউচ্চ ভবনের শীর্ষ তলায় থাকার অর্থ এই নয় যে আপনি এডিস মশা থেকে নিরাপদে আছেন। এই মশা বহুতল ভবনেও পৌঁছাতে পারে। বাসার বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পরিষ্কার পানি সরিয়ে আপনার বাড়িতে মশার প্রজনন রোধ করুন। বাসার ফুলের টবে, টায়ারে, এয়ার কন্ডিশনার/এসি থেকে নি:সৃত পানি, বাসার ছাদ উল্লেখিত স্থানগুলোতে যেন পানি না জমে থাকে; খেয়াল রাখবেন যেন পরিস্কার থাকে বাড়ির আঙিনা। জমে থাকা পানি থেকে জন্ম হয় এডিস মশার। বর্ষার সময় ডেঙ্গু জ্বর থেকে রক্ষা পেতে মশারির নীচে শোয়া উচিত।
পরিশেষে বলি অসুস্থ হলে নিজে নিজে ঔষধ সেবন না করে প্রয়োজনে ডাক্তার দেখাবেন। ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। সতর্ক থাকতে হবে শরীরের প্রয়োজনে। বৃষ্টির আভাস থাকলে বাইরে যাওয়ার সময় একটু কষ্ট করে ছাতা সঙ্গে রাখুন।
লেখক-
ডা. মো. আব্দুল হাফিজ (শাফী)
বিসিএস (স্বাস্থ্য),
নাক-কান-গলা বিভাগ,
বিএসএমএমইউ (প্রেষণে), ঢাকা।
drhafiz_33@yahoo.com
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি