বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা

মো শরিফুল হাসান শিশির;
  • প্রকাশিত: ২৩ আগস্ট ২০২০, ১০:১১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ৪ বছর আগে

বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাঙালি; স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি; বাঙালির একমাত্র মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির নন, বিশ্ব মানবতার প্রতীক, মুক্তিকামী-স্বাধীনতাকামী-নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক অবিনাশী আলোকবর্তিকা। যে কারণে কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি, আমি মুজিবকে দেখেছি।

বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানেই বিশ্বমানচিত্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক আত্মবিসর্জনের স্মারক- লাল-সবুজের পতাকা। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সামনে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা “আর যদি একটা গুলি চলে আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে ……..সর্বশেষ বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারেরর সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’

‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থের লেখক আবুল মনসুর আহমেদ তার বইতে লিখেছেন প্রায় পঁচিশ লাখ মানুষ শেখ মুজিবের ভাষণ শুনতে জমায়েত হয়েছিল।নেতাজী সুভাষ বসু বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। আর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যখন রক্ত দিতে শিখেছি কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ লক্ষণীয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এখানে কতটা অগ্রগামী ছিলেন।বাঙালি জাতির মুক্তি আর স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর এই ডাক থেকেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।

সে কারণে ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ধারাবাহিক ইতিহাসের অংশ। ২৫ মার্চ কালরাতে ঘৃণ্য সেনা অভিযানের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। গ্রেপ্তারের আগেই, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সেই ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় দেশে-বিদেশে।বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি ছিল-This may be my last message from today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of The Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is Achieved.’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ৩য় খন্ড) গ্রেপ্তারের পর পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের নির্জন-অন্ধকার কারাগারে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর বিচার। এতে তার ফাঁসির আদেশ হয়।

কারাগারের যে সেলে বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়েছিল, সেই সেলের পাশে কবরও খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতা, মুক্তির প্রশ্নে ফাঁসির আসামি হয়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিচল, আপসহীন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি ও প্রহসনের বিচার বন্ধ করতে প্রবল বিশ্ব জনমতের চাপের মুখে স্বৈরাচার পাকিস্তানি সরকার ফাঁসির আদেশ কার্যকর করতে সাহস পায়নি। মুজিবনগর সরকার : বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনাসহ দেশের সার্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়।জেনারেল এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক করে মুক্তিযুদ্ধকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামানকে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে দায়িত্ব দেয়া হয়।

দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধেত্রিশ লাখ শহীদ এবং তিন লাখ মা বোনের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর আসে আমাদের বিজয়। বাঙালী জাতি মুক্ত হয় পরাধীনতার শৃংখল থেকে। কিন্তু মুক্তির অপূর্ণতা রয়ে যায় স্বাধীনতার স্থাপতি তখন নির্জন কারাগারে।১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে, তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন দেশে। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনককে বরণ করতে লাখো মানুষের ঢল নামে বিমানবন্দরে। দেশে ফিরেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু । স্বাধীন বাংলাদেশের নামকরন যেভাবে হলো ১৯৬৯ সাল। শুরু হয় আইয়ূব পতন আন্দোলন। সেসময় গণঅভ্যুত্থানে স্লোগান দেয়া হয় “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।”ইতিহাস অনুযায়ী, ওই প্রথম পূর্ব বাংলাকে “বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করা হয়।পরে ১৯৬৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, “আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ”।এই নাম দেয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন-১৯৫২ সালে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলা ভাষা থেকে- বাংলা। এর পর স্বাধীন দেশের আন্দোলন সংগ্রাম থেকে- দেশ। এই দুটি ইতিহাস ও সংগ্রামকে এক করে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ করা হয়।১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যখন প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়, সেই সময়ও দেশটির সাংবিধানিক নাম দেয়া হয় ‘বাংলাদেশ’।

উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ১৯৭১ এর ২৩ শে মার্চ তার ধানমন্ডি ৩২ এর বাসভবনে স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকাও উত্তোলন করেন। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ আর বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র একজন নেতার ইশারায় সাতকোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মাত্র নয় মাসে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এরকম দৃষ্টান্ত আর নেই। বাঙালীর পক্ষে এটি সম্ভব হয়েছে বস্তুত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের নির্মোহ ও নির্ভরযোগ্য নির্দেশনার জন্য।একটি স্বাধীন দেশের জন্য বঙ্গবন্ধু তার জীবন ও যৌবনের ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বছরের পর বছর তাকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে। দেশের প্রতি, দেশের মাটির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল বলেই তিনি এটা করতে পেরেছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতার শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকচক্রের হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন।বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রিত রাজনৈতিক ধারাকে বদলে ফেলার কুপ্রচেষ্টা ছিল। শুধু দিক পরিবর্তন নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দর্শনাশ্রিত গতিধারা চিরতরে রুদ্ধ করে বাংলা ও বাঙালির চিরায়ত রাজনীতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যবিরোধী দর্শন চালুরও অপচেষ্টা হয়েছে। “নির্বোধ ঘাতকরা জানেনা মৃত্যুতে থামেনা জীবন! বাংলাদেশের আরেক নাম শেখ মুজিবুর রহমান”। সৌভাগ্য বাঙালির যে, সেদিনের নৃশংসতা থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা- শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।শেখ হাসিনা তার পিতার অসমাপ্ত কাজগুলো করতে পারছেন বলেই আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দর্শন, আদর্শকে আঁকড়ে ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পথে চলতে পারছে। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন। কার্যকরও করেছেন বিচারের রায়। স্বাধীনতাবিরোধী মহল ছাড়া এটি সব বাঙালির কাঙ্ক্ষিত ছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক। তিনি বাংলার মাটি ও মানুষের পরম আত্মীয়, শত বছরের ঘোর নিশীথিনীর তিমির বিদারী অরুণ, ইতিহাসের বিস্ময়কর নেতৃত্বের কালজয়ী স ষ্টা, বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। বাঙালি জাতির পিতা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। উন্নত সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্নসারথি এ কথাই যেন ব্যক্ত হয়েছে অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই শব্দগুচ্ছে- ‘যতদিন রবে পদ্মা-যমুনা গৌরী-মেঘনা বহমান ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

মো শরিফুল হাসান শিশির- লেখক ও গবেষক, সার্জেন্ট অব এসএমপি

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি