সব
প্রতিবেশীর সন্তান স্কুলে যায়। এ নিয়ে সোনা মিয়ার বেশ মন খারাপ। মনের গোপন হিংসা-জ্বালা ঘরের জিজ্ঞাসা; কেন পড়ছে! একদিন আমাদের ছাড়িয়ে-মাড়িয়ে-বাড়িয়ে যাবে না তো? হিংসা অনলে পুড়ে পুড়ে মনের সান্ত্বনা খুঁজে পান এভাবে- ‘পড়লেই তো হবে না, পাশ করতে হবে।’
পাশ করার পরে আরো হিংসা সমৃদ্ধি করে। এবারের চিন্তা, প্রাইমারি গন্ডি কোনোদিন পার হবে না। প্রাইমারির গন্ডি পার করায় এসএসসি পরীক্ষায় চিন্তা, এবার নির্ঘাত ফেল। না হতচ্ছাড়া প্রতিবেশী সন্তানদের ঠেকানো গেলো না! পাশ করেই ফেলেছে। পরীক্ষা পাশের মিষ্টিগুলো মিছরির ছুরির মতো বুকে বিঁধে আছে। এবার ভয়ানক প্রতিবেশীর একটু সান্ত্বনা- এটুকু পাশ করে কী হবে? কতো পাশ দেখলাম, চাকরি পাবে না। এক সময়ের বিন্দু-বিন্দু সিন্ধু হিংসা-জ্বালা নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুটি এখন দেশের কোনো এক সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানের প্রধান।
প্রতিবেশি সোনা মিয়া, চাঁন মিয়া, যদু,মধুদের হিংসা-বিদ্বেষ দৃষ্টিসীমার দূরে থাকায় হয়তো বা এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে আপাত কোনো সমস্যা নেই; কিন্তু এখানেও প্রতিবেশি ভয়ানক হিংসুটে ভাবনার সোনামিয়া, তারা মিয়া, চাঁনমিয়া, বাতাসি আপা, যদু,মধু,কদু বসে আছে। সে খবর এখনো সহজ-সরল গ্রামের ছেলেটি জানে না।
প্রতিবেশি ভাবনা এখন আর ভাবনা জগতে সীমাবদ্ধ নেই। হিংসা-জ্বালা চাষাড়ে প্রতিবেশি ভাবনা তিলে তিলে বেড়ে উঠেছে এক ভয়ানক ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবে। তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সবখানে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানব প্রতিবেশী ভাবনায় ভর করে মিছরির ছুরি দিয়ে কাবু করে চলেছে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশ। ফুল মিয়া, তেল মিয়া, সোনা মিয়া, যদু,মধু, কদু হয়ে গুম, ধর্ষণ, চুরি, মাদক, ডাকাতি করে বসে নেই। তাদের এখন চিন্তা রাষ্ট্রযন্ত্রের সবখানে মানবিকতার বদলে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবের বীভৎস চেহারা সাঁটানো। সে দানবে ভর করে তারা বাঁচবে, গাইবে, হাসবে, নাচবে, নাইবে।
প্রতিবেশী আচরণ, ভাবনার সাথে সবাই সাপে-নেউলে ফোঁসফোঁস করে বেঁচে গেলেও চলার পথে অপেক্ষা করছে নতুন-নতুন প্রতিবেশি। বাড়ি প্রতিবেশীর আচরণ আঁচ করে পুকুরের মাছ, দুধেল গাভী, মাঠের ফসল, ফলদ, বনজ সম্পদ বিক্রি, পাহারা দিয়ে রক্ষা করতে পারলেও নতুন-নতুন প্রতিবেশি দানব ভাবনা হতে কারোর রেহাই মিলছে না। সে দানব ভাবনার সবাই খেলার পুতুল মাত্র। দল ভারি করে বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের ‘দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অভ ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড (১৮৮৬) চরিত্রের মতো আগাগোড়া নৈতিবাচক ভন্ড, কুৎসিত চরিত্রে সবাইকে ডাকছে। সবাই দেখানো পথে হাঁটছে, নেই কারোর বোধ।
ফেসবুক এখন প্রতিবেশী ভাবনার যারপরনাই কান্না। সকালে তেমন কেউ পত্রিকায় হাত দেয় না। হাতে একপলকে পত্রিকার হেডলাইন চোখ বুলিয়ে ভার্চুয়াল জগতে হারিয়ে যায়। সেলিব্রেটি হতে চা দোকানের গ্লাস বয়; সবারই স্বনাম, ছদ্মনাম ফেসবুক একাউন্ট। বিদঘুটে নামের বাহার নিয়ে ব্যবহার। বর্তমানে প্রত্যেক ফেসবুক ব্যবহারকারী ভার্চুয়াল জগতে আরেকটি স্বতন্ত্র সত্তা ধারণ করেন। রান্না, কান্না, যুদ্ধ, প্রেম, বিরহ, এমন কি মল ত্যাগের দৃশ্য ও হতচ্ছাড়া নয়নে দেখতে হয়। ফেসবুক উদ্দেশ্য-এখন কেউ মেনে চলছে না, নিউক্লিয়ার প্রতিবেশী ভাবনা নিয়ে যে যেভাবে পারছে, ব্ল্যাকমেইল করেই চলেছে- বন্ধু, দোস্ত সেজে হুল ফুটিয়ে ‘দোস্ত দুশমন’ ছবি প্রতিদিনই সাইন আপ করে চলেছে, থানা পুলিশ, কোর্ট, সাইবার ক্রাইম, সাইবার বুলিং তদন্ত। অবস্থা এমন হয়েছে যে, চ্যাটগুলো পর্যন্ত অবিমৃষ্য ভাবনায় ব্যবহার করে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করে চলেছে। ফেসবুক এখন প্রতিবেশী ভাবনার মৃত্যুদূত! প্রতারণা-ভণ্ডামি ভার্চুয়াল জগত। আগে মিস কল, এখন ফেসবুকে পরিচয়ে বিয়ের টোপ, গাড়ি, বাড়ি, বাগান বাড়ি, চাকরি, বাহারি কৌশলী চাল দিয়ে বিশ্বাস উপহারে- পতিতা, দেশান্তরি, সুরতহাল।
ফেসবুক প্রতিবেশী ভাবনা নিয়ে আমরা এতোবেশি সময় ব্যয় করছি যে, বাস্তবজ্ঞান আর থাকছে না। বাস্তবতা আমাদের সবার কাছে নিরর্থক হয়ে মেকি ভার্চুয়াল পৃথিবী বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তরুণ, ছাত্র, গৃহবধূ, প্রায় সবাই ফেসবুককে তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ধরে নিয়েছে। তাদের কাছে জীবন বন্দনার চেয়ে লাইক, কমেন্টস, শেয়ার অনেক অনেক মূল্যবান। মেকি ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এভাবে সবাই নিজেকে বিকিয়ে দেবার ফলে তরুণ সমাজ আজ তাদের সমস্ত মানসিক উদ্যম হারিয়ে নির্জীব হয়ে পড়েছে। তারা দৈনন্দিন পড়াশোনা, বই পড়া বাদ দিয়ে যৌন সুড়সুড়ি তাড়না-ভাবনা নিয়ে হয়ে যাচ্ছে-অস্থিরচিত্ত ও বিষন্ন। সিজোফ্রেনিয়া ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে মাদক, অবাধ যৌনাচার, বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের সামগ্রিক চেতনা মানসিক সু-স্বাস্থ্যের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, পাবজি, অসংখ্য হিংসুটে গেমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো একচেটিয়া ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা তরুণদের পড়াশোনা ছাড়া রাতারাতি শর্টকাট বড়লোক হবার লোভ দেখিয়ে ব্যবসার পরিধি বাড়াচ্ছে। ভয়ানক ব্যাপার হলো-লোভে পড়ে নিজের অজান্তে কিশোর, যুবক-যুবতীর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের গঠনকে ধ্বংস করে ফেলছে। মানবীয় ঘরানাকেন্দ্রিক কোনো গেম,পাঠ তেমন কেউ দেখেনা-পড়ে না।
এভাবে চলনে, বলনে, গঠনে তৈরি হচ্ছে, আস্তে-আস্তে একটি স্বপ্নহীন, মেধাহীন জাতীয় চেতনাহীন প্রজন্ম। অনাগত দিনগুলোতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এ প্রজন্মই নিয়ন্ত্রণ করবে। এখন সামনের সারিতে থেকে যে বিদগ্ধ মহানজন দেশকে ভিশন সমৃদ্ধি রূপকল্প -২০৪১ উন্নত রাষ্টের স্বপ্নপূরণে অহর্নিশ কাজ করে চলেছেন; সে পর্যন্ত বিদগ্ধ মহানজন কতোজন সামনে থেকে দুর্নীতি কমানো এবং সর্বক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে প্রতিপাদন করার ক্ষেত্রে নিজেই থিতু থাকতে পারবেন, তা দেখার বিষয়। কারন “বায়োলজিক্যাল ক্লক” (Biological clock) সময় ও স্রোতের মতো অপেক্ষা করে না। সে নিরিখে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আমার মতো অল্প বোধসম্পন্ন লোকদের বোঝাতে বলেছিলেন-“আপনার হাত গরম উনুনের উপর রাখুন, একঘণ্টা মনে হবে।”সুন্দরী মেয়ের পাশে একঘণ্টা বসুন, মনে হবে মাত্র এক মিনিট বসেছেন।”
তাই সময় থাকতে- প্রজন্মান্তর রক্ষা করতে হবে। প্রজন্মের সুন্দর ভাবনাগুলো আপেক্ষিকতা তত্ত্বে সুন্দরীর পাশে বসিয়ে রাখলে বন্দিদশা হতে মুক্তি পাবে না। চোর, ডাকাত, ধর্ষক, মুখোশ বাবা, মাস্তানবাবা,নেংটা বাবা, মাদক বাবা, ভন্ডবাবা, ফেবুবাবা, সুযোগবাবা সব বাবাদের দখলে “প্রতিবেশী ভাবনা” বন্দিঘর হতে মুক্তি পেতে পরিবার, সমাজ ও দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। নচেৎ প্রতিবেশী ভাবনা যারপরনাই কান্না কোনোদিনই শেষ হবে না।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি পুলিশ পরিদর্শক,বাংলাদেশ পুলিশ
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি