পুলিশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন

মো. শরিফুল হাসান;
  • প্রকাশিত: ১৪ আগস্ট ২০২০, ৩:৪৩ অপরাহ্ণ | আপডেট: ৪ বছর আগে

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পুলিশ সপ্তাহে ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি নিচে আংশিক দেওয়া হলো।
‌‘আজ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। যতদিন বাংলার স্বাধীনতা থাকবে, যতদিন বাংলার মানুষ থাকবে, ততদিন এই রাজারবাগের ইতিহাস লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। ২৫ মার্চ রাত্রে যখন ইয়াহিয়া খানের সৈন্য বাহিনী বাংলাদেশের মানুষকে আক্রমণ করে, তখন তারা চারটি জায়গা বেছে নিয়ে তার ওপর আক্রমণ চালায়। সেই জায়গা চারটি হচ্ছে—রাজারবাগ, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর আমার বাড়ি। একই সময়ে তারা এই চার জায়গায় আক্রমণ চালায়। রাজারবাগের পুলিশেরা সেদিন সামান্য অস্ত্র নিয়ে বীর বিক্রমে সেই সামরিক বাহিনীর মোকাবেলা করেন। কয়েক ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ করেন। তারা এগিয়ে আসেন বাংলাদেশের মানুষকে রক্ষা করতে।’
‘এর জন্য আজ আমি গর্বিত। আজ বাংলার জনগণ গর্বিত। সেদিন বাংলার জনগণের ডাকে, আমার হুকুমে এবং আমার আহবানে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী এগিয়ে এসেছিল মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে। বাংলাদেশের জনগণকে রক্ষা করতে। স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে রাজারবাগের এবং পুলিশের ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পুলিশ বাহিনীর অনেক কর্মী এখানে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তারা রাস্তায় নেমে যুদ্ধ চালিয়েছিলেন নয় মাস পর্যন্ত। যারা পুলিশ বাহিনীর বড় বড় কর্মচারী ছিলেন, তাদেরও অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছিলেন।’

‘আজ তিন বছর হলো বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আজ প্রথম আমাদের পুলিশ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। এখন একটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার। যে রক্ত দিয়ে আমরা স্বাধীনতা এনেছি, সেই রক্ত দিয়েই স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। পুলিশ বাহিনীর ভাইয়েরা, এই রাজারবাগে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের কথা মনে রাখতে হবে। তারা আপনাদেরই ভাই। তারাও পুলিশে চাকরি করতেন। জনগণের সঙ্গে তারা হাত মিলিয়েছিলেন। ত্রিশ লক্ষ লোকের সঙ্গে পুলিশের অনেক লোকও আত্মত্যাগ করেছিলেন। তাদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। তাদের ইজ্জত আপনারা রক্ষা করবেন। তাদের সম্মান আপনারা রক্ষা করবেন। তাদের আত্মা যাতে শান্তি পায়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কষ্টকর।’

‘আজ আপনাদের কর্তব্য অনেক। যেকোনও সরকারের, যেকোনও দেশের সশস্ত্র বাহিনী গর্বের বিষয়। আমার মনে আছে যেদিন আমি জেল থেকে বের হয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বুকে ফিরে আসি, সেদিন দেখেছিলাম আমাদের পুলিশ বাহিনীর না আছে কাপড়, না আছে জামা, না কিছু। অনেককে আমি ডিউটি করতে দেখেছি লুঙ্গি পরে। একদিন রাত্রে তারা আমার বাড়ি গিয়েছিল। তাদের পরনে ছিল লুঙ্গি, গায়ে জামা, হাতে বন্দুক।’

‘একটা কথা আপনাদের ভুললে চলবে না। আপনারা স্বাধীন দেশের পুলিশ। আপনারা বিদেশি শোষকদের পুলিশ নন- জনগনের পুলিশ। আপনাদের কর্তব্য জনগণের সেবা করা, জনগণকে ভালোবাসা, দুর্দিনে জনগণকে সাহায্য করা। আপনাদের বাহিনী এমন যে, এর লোক বাংলাদেশের গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। আপনাদের নিকট বাংলাদেশের মানুষ এখন একটি জিনিস চায়। তারা যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারে। তারা আশা করে, চোর, বদমাইশ, গুণ্ডা, দুর্নীতিবাজ যেন তাদের ওপর অত্যাচার করতে না পারে। আপনাদের কর্তব্য অনেক।’

‘আমি জানি, আপনাদের নানা রকম অসুবিধা আছে।‘আমি আপনাদের কাছে এই আশা করব যে, আপনারা হবেন আমার গর্বের বিষয়। বাংলাদেশের মানুষ যেন আপনাদের জন্য গর্ব অনুভব করতে পারে। আপনারা যদি ইচ্ছা করেন, আপনারা যদি সৎ পথে থেকে ভালোভাবে কাজ করেন, যদি দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকেন, তাহলে দুর্নীতি দমন করতে পারবেন। আপনারা যদি আজকে ভালোভাবে থাকেন, শৃঙ্খলা বজায় রাখেন, তাহলে আমি বিশ্বাস করি, যে থানায় ভালো অফিসার আছেন এবং ভালোভাবে কাজ করছেন, সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনও প্রকার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে না। কারণ, তারা সবসময় সজাগ থাকেন এবং দুষ্টকে দমন করেন। যিনি যেখানে রয়েছেন, তিনি সেখানে আপন কর্তব্য পালন করলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে না।’

‘মনে রাখবেন, আপনাদের মানুষ যেন ভয় না করে। আপনাদের যেন মানুষ ভালোবাসে। আপনারা জানেন, অনেক দেশে পুলিশকে মানুষ শ্রদ্ধা করে। আপনারা শ্রদ্ধা অর্জন করতে শিখুন।’

‘আপনাদের বনে-বাদাড়ে নদীতে লোকালয়ে সর্বত্র যখন যেখানে প্রয়োজন পড়ে, ডিউটি করতে হয়। চব্বিশ ঘণ্টা মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে হয়। অনেকে বলেন যে, সকলের ছুটি আছে, কিন্তু পুলিশের ছুটি নেই। এজন্য আমার দু:খ হয়। সংখ্যায় আপনারা খুব কম বলেই আপনাদের রাত দিন কাজ করতে হয়।‘জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন। মানুষের ওপর অত্যাচার করবেন? গরীবের ওপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে। তাই শুধু আপনাদের নয়, সমগ্র সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যেন কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন।’

‘আর যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটা নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনারা সেই দিকে খেয়াল রাখবেন। আপনারা যদি অত্যাচার করেন, শেষ পর্যন্ত আমাকেও আল্লাহর কাছে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কারণ, আমি আপনাদের জাতির পিতা, আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনাদের নেতা। আমারও সেখানে দায়িত্ব রয়েছে। আপনাদের প্রত্যেকটি কাজের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত আমার ঘাড়ে চাপে, আমার সহকর্মীদের ঘাড়ে চাপে। এজন্য আপনাদের কাছে আমার আবেদন রইলো, আমার অনুরোধ রইলো, আমার আদেশ রইলো, আপনারা মানুষের সেবা করুন। মানুষের সেবার মতো শান্তি দুনিয়ায় আর কিছুতে হয় না। একটা গরিব যদি হাত তুলে আপনাকে দোয়া করে, আল্লাহ সেটা কবুল করে নেন। এজন্য কোনদিন যেন গরিব-দুঃখীর ওপর, কোনদিন যারা অত্যাচার করেনি, তাদের ওপর যেন অত্যাচার না হয়। যদি হয়- আমাদের স্বাধীনতা বৃথা যাবে।’

‘আমার ভাইয়েরা, এক দল লোকের পয়সার লোভ অত্যন্ত বেড়ে গেছে। পয়সার জন্য তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মৃত্যুর পর এ পয়সা তাদের কোন উপকারে আসবে না। এই পয়সায় যদি তাদের সন্তানরা মানুষ না হয়, তাহলে তারা নানা অপকর্মে তা উড়িয়ে দেবে। তাতে তারা লোকের অভিশাপ কুড়িয়ে আখেরাতেও শান্তি পাবে না। তাই আমি সকলকে অনুরোধ করি, রাত্রে একবার চিন্তা করবেন, সারাদিন ভালো কিছু করেছেন, না মন্দ করেছেন। দেখবেন, এতে পরের দিন মনে আশা জাগাবে যে, আমি ভালো কাজ করতে পারি। এ দেশের মানুষ বহু কষ্ট করেছে। যুগ যুগ ধরে তারা কষ্ট করছে। এই বাংলাদেশে কয়েক হাজার লোক না খেয়ে মারা গেছে। এবার আমি আপনাদের কাছে সাহায্য চাই। আপনারা একবার আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করুন, দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকব। প্রতিজ্ঞা করুন- আমরা দুর্নীতিবাজদের খতম করব। প্রতিজ্ঞা করুন- আমরা দেশকে ভালোবাসব, দেশের মানুষকে ভালোবাসব। প্রতিজ্ঞা করুন- আমরা দেশের মাটিকে ভালোবাসব। যারা দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, রাতের অন্ধকারে যারা মানুষ হত্যা করে, থানা আক্রমন করে অস্ত্র নিয়ে যায়, আপনারা মোকাবেলা করে বাংলাদেশের মাটি থেকে তাদের উৎখাত করুন।’‘আপনাদের দুঃখ-কষ্টের কথা আমি জানি। আপনাদের খাওয়া-পরার কষ্টের কথাও। কিন্তু কষ্ট কি শুধু আপনারাই করছেন? যাদের টাকা দিয়ে আমরা চলি, তারাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট করছে। আমরা চাই একটা শোষণহীন সমাজ। আমরা চাই ইনসাফের রাজত্ব। আমরা চাই মানুষ সুখী হোক, গরিব-দুঃখী, বড়-ছোট পেট ভরে ভাত খাক। তাহলেইতো আমাদের স্বাধীনতা সার্থক হবে। যারা আত্মত্যাগ করেছে, রক্ত দিয়েছে, তাদের আত্মা শান্তি পাবে।’

‘আজ হতে শুরু হোক আপনাদের নতুন জীবন। এই পুলিশ সপ্তাহ থেকে আপনারা নতুন মনোভাব নিয়ে কাজ শুরু করুন, যাতে বাংলাদেশের পুলিশ দুনিয়ার বুকে গর্বের বস্তু হয়ে উঠতে পারে। এটিই আমি চাই আপনাদের কাছে। আপনাদের জন্য আমার সহানুভূতি আছে। আপনারা জানেন, আপনাদের আমি ভালোবাসি। আপনাদের জন্য চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করেও আমি ক্লান্তি বোধ করি না। কিন্তু আমি চাই, আপনারা মানুষকে ভালোবাসুন। তাহলেই শান্তি আসবে।’

‘আমি আপনাদের এই সপ্তাহে কামিয়াবি কামনা করি এবং আরও কামনা করি সব পুলিশ কর্মচারী যিনি যেখানেই থাকুন না কেন, সবাই যেন সৎ হওয়ার এবং মানুষকে ভালোবাসার সুযোগ পান। আজকে আপনারা আরও প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা এমন পুলিশ গঠন করবো, যে পুলিশ হবে মানুষের সেবক, শাসক নয়। আমি পুলিশ বাহিনীর ভাইদের আন্তরিক মোবারকবাদ জানিয়ে বলছি, একদিন বাংলার মানুষ সুখী হবে, এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সৎ পথে থাকতে হবে।’
‘খোদা হাফেজ, জয় বাংলা।’

 

  • তথ্যসুত্র : মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশের গৌরবগাথা
  • লেখক
  • মো. শরিফুল হাসান
    ট্রাফিক সার্জেন্ট, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি