পাথরে কত ‘মধু’

সাঈদ চৌধুরী টিপু;
  • প্রকাশিত: ১৯ জুলাই ২০২০, ১০:৫৩ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ৪ বছর আগে

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে প্রকৃতির পরম যতনে গড়া নিসর্গভূমি। ধলাই, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ জলের মাঝে উঁকি দেয় চকচকে পাথর। মন ভুলায় পর্যটকদের। দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারি ভোলাগঞ্জের অবস্থান এই উপজেলাতেই। পাথরের রুক্ষ রূপও কোম্পানীগঞ্জকে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। মাটি খুড়ে, নদীর তলদেশ তুলে আনা পাথরের সাথে জড়িয়ে আছে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। কাচা টাকার টানে অনেকেই ছুটে আসেন কোম্পানীগঞ্জে। টাকায় সুখ কিনতে গিয়ে অনেকেই জড়িয়ে পড়েন অপরাধের সাথে। পাথরের পরশে হাতে আসা টাকায় তারা প্রভাব বিস্তার করতে চান সব কিছুতেই। টাকার গরমে পার পেয়ে যাওয়ায় তারা একেকজন হয়ে উঠেন অপরাধজগতের বেপরোয়া কাণ্ডারি। পাথরে কেনা মধুর লোভে দূরের গডফাদাররাও তাদের কাছে ভেড়েন। মাথার উপর ছাতা পেতে সেই সব গডফাদারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন পাথরের যুবরাজরা। গডফাদারদের ছায়ায় অপরাধজগতে তারা হয়ে উঠেন আরো লাগামহীন।
সিলেটের পাথরের যে কত মধু তার ধারণা পাওয়া যায় ক্যাসিনোকাণ্ডে ‘থাই ডন’ সেলিম প্রধানের গ্রেপ্তারের পর। তখন জানা যায় ২০১৮ সালের এক মাসেই পাথর কোয়ারি থেকে তিনি ১০ কোটি টাকা। এমন আরো কত ‘ডনে’র পকেটে কোম্পানিগঞ্জের পাথরের টাকা যায় তার কোনো হিসেব নেই। শুধু জানা যায় তারা ‘বেকায়দা’য় পড়লে।
শুধু কোম্পানীগঞ্জই নয় সিলেটে যেখানে পাথর আছে সেখানেই চোখ আছে অপরাধীদের। করোনার নমুনা পরীক্ষা নিয়ে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ করিমের পকেটেও আছে সিলেটের পাথরের টাকা। এ বিষয়টিও জানা যায় তিনি ‘বেকায়দায়’ পড়ার পর। সাহেদ করিমের অপকীর্তি ফাঁস হতে থাকলে জানা যায়, সিলেট পর্যন্তও বিস্তৃত ছিলো তার অপকর্মের জাল। সিলেটের গোয়াইনঘাটের জাফলংয়ের এক পাথর ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকার পাথর নিয়ে এক টাকাও দেননি সাহেদ করিম। টাকা চাওয়ায় উল্টো প্রাণে মারার হুমকি দিয়েছিলেন শামসুল মাওলা নামের ওই ব্যবসায়ীকে।
করোনাকালেও থেমে নেই পাথর নিয়ে কামড়া-কামড়ি। তবে করোনার এই দুঃসময়ে কোম্পানীগঞ্জ কিংবা গোয়াইনঘাট নয় সবাইকে টেক্কা দিয়ে পাথরভুবনে’র আলোচনায় উঠে এসেছে কানাইঘাট। কানাইঘাটের লোভাছড়া কোয়ারির পাথর ইস্যু হাইকোর্টেও উঠেছে। হাইকোর্টের নির্দেশনার পরও থেমে নেই ‘পাথরলড়াই’।
বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে কানাইঘাটে সীমান্তনদী লোভা’র তীরে অবস্থিত ৪০২ দশমিক ৮৯ একর আয়তনের এই পাথর কোয়ারির ১৪২৬ সনের শেষ দিন, ইংরেজি বর্ষপঞ্জির হিসেবে যা ১৩ এপ্রিল। ইজারার মেয়াদ শেষ হলে বাংলাদেশ খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমএডি) ২৮ মে একটি পত্রের মাধ্যমে বিষয়টি কানাইঘাট উপজেলা প্রশাসনকে অবহিত করে। করোনা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে সময় বাড়াতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন ইজারাদার সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপপ্রচার সম্পাদক মস্তাক আহমদ। আদালত এক দফা সময়ও দেন। পরবর্তীতে ৯ জুন লোভাছড়া কোয়ারির পাথর ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিনও পাথর সরিয়ে নিতে হাই কোর্টের বিচারপতি জেবিএম হাসানের আদালতে পৃথক আবেদন করে সময় প্রার্থনা করেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত গিয়াস উদ্দিনকে এক মাস সময় দেন। এরই মাঝে সিলেটের স্থানীয় অধিবাসী নজরুল ইসলাম ও খুরশেদ আলম শিপলু নামের দুই ব্যক্তি একই আদালতে সময় বাড়ানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলে বিচারপতি জেবিএম হাসান ২৩ জুন গিয়াস উদ্দিনের পক্ষে দেওয়া পূর্বের দেওয়া আদেশটি রিকলের মাধ্যমে বাতিল করেন। এরপর প্রশাসন অভিযান চালায় পাথর কোয়ারিতে। এরপরও নৌকা ভরে চুপি-চুপি পাথর সরে যেতে থাকে কোয়ারি থেকে এমনই অভিযোগ উঠে। কানাইঘাটের পাথরের ধাক্কা পড়ে পাশের উপজেলা বিয়ানীবাজারেও। এ নিয়ে বিয়ানীবাজার থানার ওসির সাথে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম পল্লব। মঙ্গলবার দুপুরে বিয়ানীবাজারের চারখাই এলাকার কছকটখা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীপথে পাথর বোঝাই কয়েকটি নৌকা আটক করা হয়। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দাবি এগুলো অবৈধভাবে পাথর নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওই নৌকাগুলো নাকি পরে থানার ওসি ছেড়ে দেন। শুধু ওসি নয় এ নিয়ে চেয়ারম্যান পল্লবের ক্ষোভ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধেও। ফেসবুকে পাল্টাপাল্টি ভিডিও বার্তা আপলোড করেন।
করোনাকালের ‘পাথরসময়ে’ আরো একটি ঘটনা ঘটেছে। স্পট সেই পাথররাজ্য কোম্পানীগঞ্জ। ঢলের পানিতে ভেসে আসা পাথর এসে জমা হয়েছে কোম্পানীগঞ্জের পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথরে। প্রায় ১০ একর জায়গাজুড়ে দৃশ্যমান হয়েছে সাম্প্রতিক পাহাড়ি ঢলে ভেসে আসা নতুন পাথরের স্তূপ। সাদাপাথরের রূপ আরও বাড়িয়ে তুলেছে নতুন জমা হওয়া পাথর। জানা গেছে, পাথরের স্তূপ সুরক্ষিত রাখতে ওই এলাকায় যাতায়াত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে উপজেলা প্রশাসন। পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দুটি ফাঁড়ি বিশেষ নজরদারির মধ্যে রেখেছে পুরো এলাকা। করোনা সংক্রমণের এই সময়ে পাথরখেকোরা হয়তো নীরব বসে থাকবে। কিন্তু এরপর কি তারা থেমে থাকবে? এটা বোধহয় কোটি টাকার প্রশ্ন-কারণ এই পাথরের ‘মধু’ দিয়ে অনেক কিছুই জয় করা যায়। সে ‘মধু’র লোভ সামলানো সহজ কথা নয়।

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি