সব
নামগঞ্জ জেলার আদি ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন কালে লাউড় নামে একটি আলাদা রাজ্যপাট ছিল। লাউড়ের ইতিহাস অতি প্রাচীন অসংখ্য কিংবদন্তী এবং ঘটনাবলী ও তথ্যবলীতে তৎকালীন লাউড় রাজ্য সমবৃদ্ধ। লাউড় রাজ্যের রাজ্যপাল ছিলেন কেশব মিশ্র নামক জৈনেক ব্যক্তি।
লাউড়ের রাজারা ছিলেন কাত্যান গোত্রীয় মিশ্র তাদের উপাধি ছিল সিংহ। লাউড় রাজধানী লাউড় ছাড়া অন্য অংশ ছিলো জগন্নাথপুর ও বানিয়াচং এ রাজ্যের সীমানা জুড়ে বিসৃত। বর্তমানের সুনামগঞ্জ জেলা,ময়মনসিংহ জেলা,হবিগঞ্জ কিয়দংশ নিয়ে গঠিত ছিলো তৎকালীন লাউড় রাজ্য।
তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের হলহলিয়া গ্রামে তৎকালীন লাউড়ের রাজা বিজয় সিংহের বাসস্থানের ধংসাবশেষের এখনো বিদ্যমান রয়েছে যা বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কতৃক তত্ববধানে রয়েছে। লাউড়ে পঞ্চদশ শতাব্দীতে দিব্যসিংহ নামে জনৈক রাজা রাজত্ব করতেন! কথিত আছে বিখ্যাত বৈষ্ণব সাধক অদ্ধৈতাচার্যের পিতা কুবের আচার্য তর্কপঞ্চানন দিব্য সিংহের মন্ত্রী ছিলেন।
লাউড়ের রাজা দিব্যসিংহ বৃদ্ধ বয়সে রাজ্যভার তদীয়পুত্রের হাতে ছেড়ে দিয়ে সন্যাসব্রত গ্রহন করেন এবং তদীয় মন্ত্রী পুত্র অদ্ধৈতাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। অদ্ধৈতাচার্যই বৈষ্ণব ধর্মের উজ্জ্বলতম নামে খ্যাত এবং দিব্যসিংহ কৃষ্ণদাস নামে পরিচিত।
“কৃষ্ণদাস নাম তার অদ্ধৈত রাখিলা অদ্ধৈত চরিত কিছু তোহা প্রকাশিলা”অদ্ধৈতাচার্যের বাল্যনাম ছিল “কমলাক্ষ”তিনি বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়ন লাউড় পরগনার নবগ্রামে ১৪৩৪/৩৫ খৃস্টাব্দ আবিভুত হন। বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করার পর তার নাম হয় অদ্ধৈত।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে অদ্ধৈতার্য চৈতন্য বিষয়ক পদ রচনার সুত্রপাত করেন!প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ সাহেবের মতে সুনামগঞ্জ হিন্দু সমাজের সংস্কৃতি গড়ে উঠে শ্রী চৈতন্য দেব প্রচারিত বৈষ্ণবধর্ম সুচনা থেকে। অদ্ধৈত পুণ্যাহ স্মৃতি বিজড়িত স্থান ও সাধনা ফসল পনাতীর্থ অদ্যাবধি এখানে তার স্মৃতি বহন করে চলেছে।
কালের কড়াল গ্রাসে অদ্ধৈত বাড়ী ও তার নির্মিত আশ্রম যাদুকাটা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে! যা নব্যগ্রাম নামে খ্যাত ছিল। দেশ বিদেশ হতে বহু ভক্ত অনুসারীগণ পুণ্যার্থীরা এখানে আসেন পুণ্য স্থানের উদ্দেশ্য। ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে এই পণতীর্থের সূচনা করেন শ্রীমান অদ্বৈত আচার্য্য!
মানুষ তাঁকে গৌরআনা ঠাকুর বলে জানে!তাঁর জন্মস্থান তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের নবগ্রামে। নদী ভাঙনে নবগ্রাম আজ বিলীন! সে সময় নবগ্রামের অবস্থান ছিল লাউড় রাজ্যের লাউড়েরগড় এলাকায়। বর্তমানে যে মন্দির গড়ে উঠেছে যাদুকাটা নদীর তীরবর্তী লাউড়েরগড়ের পার্শ্ববর্তী রাজারগাঁও গ্রামে।
প্রতি বছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে পুণ্যস্নানের জন্য এই স্থানে কয়েক লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে। এখানে ভক্তরা স্নান ও তর্পণ করেন। এই পণতীর্থ প্রতি বছর একবারই হয়ে থাকে। এই দিন ও ক্ষণের জন্য ভক্তরা অধীর আগ্রহে থাকেন পুরো বছর।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব সাধক অদ্বৈতাচার্য্যর পিতা কুবের আচার্য্য বা কুবের মিশ্র তর্ক পঞ্চানন রাজা দিব্য সিংহের মন্ত্রী ছিলেন। কুবের আচার্য্য ছিলেন পণ্ডিত শাস্ত্রবিদ ও সভাপণ্ডিত। কিন্তু মন্ত্রী কুবের আচার্য্যের পর পর ছয়টি সন্তান মারা যাওয়ায় তাঁর মনে ছিল প্রচন্ড কষ্ট। তাই তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ভারতে চলে যান!পরবর্তীতে রাজা দিব্য সিংহের আহবানে তিনি পুনরায় লাউড়ে ফিরে আসেন। কিছুকাল পর ১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্ত্রী নাভা দেবীর গর্ভে এক সন্তান লাভ করেন। কমলের মত সুন্দর বলে তার নাম রাখেন কমলাক্ষ। কমলাক্ষের মাতা নাভাদেবী স্বপ্নে দেখতে পান তার ক্রোড়স্থ শিশু শঙ্খচক্র গদাপদ্বধারী মহাবিষ্ণু।
তার অঙ্গজ্যোতিতে চারদিক আলোকিত, মুখে দিব্য আভা! হতবিহবল নাভা দেবী সেই স্বর্গীয় মূর্তির সম্মুখে প্রণত হয়ে শ্রী চরণোদন প্রার্থনা করেন। কিন্তু মাতা কর্তৃক সন্তানের পাদোদক প্রার্থনা করা অনুচিত। তাই স্বপ্ন ভেঙে গেলে নাভা দেবী মহাচিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কমলাক্ষের অনুরোধে স্বপ্নের সকল বৃত্তান্ত তাঁকে খুলে বলেন। সবশেষে বললেন সপ্ততীর্থ বারি অবগাহনের ভাগ্য কি আমার হবে? মায়ের অভিলাষ পূরণে কমলাক্ষ হাত মুষ্টি করে বললেন,”সপ্ততীর্থ হানি হেথায় করিব স্থাপন” আজ রাতে সকল তীর্থের এখানে আগমন ঘটবে এবং আগামী প্রাতে মাতা সে তীর্থ বারিতে অবগাহন করবেন।
নিকটস্থ শৈল শিকড়ে কমলাক্ষ অবস্থান করে প্রভাতে ঘণ্টা ধ্বনি করলেন। সাথে সাথে সকল তীর্থবারি অঝোর ধারায় বয়ে যেতে শুরু করল। কমলাক্ষের মাতা নাভা দেবীর যেন বিশ্বাস হতে চায়না-মনে প্রশ্ন জাগে এ সত্যই কি সপ্ততীর্থ? কমলাক্ষ তার মায়ের সঙ্গে সপ্ততীর্থ বারিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই হল শ্যামার সামৃত যমুনা,পাপনাশিনী গঙ্গা এবং রক্তপীথ আদি তীর্থ বারি। আনন্দ উৎফুল্ল মনে জননী তীর্থগণকে প্রণাম করে সপ্ততীর্থ বারিতে অবগাহন।
(তথ্য সুত্র -টিএসএস,স্মারক)
শওকত আখঞ্জী
উন্নয়নকর্মী ও কলামিস্ট
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি