সব
আর্থিক টানাপোড়েন ও পারিপার্শ্বিক নানান সমস্যায় পড়াশোনায় প্রাইমারির গন্ডি পেরুতে পারেননি। আশির দশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়ে সিলেট জেলা শহরে এসেছিলেন তিনি। এখানে এসে ১৯৮২-৯৯ সাল পর্যন্ত কখনো দিনমজুরি, কখনো ঠিকাদারী ব্যবসা আবার কখনো অন্যের অধীনে চাকরি করেছেন।
বার বার পেশা পাল্টেছেন নিজের ভাগ্যবদলের আশায়। শেষ পর্যন্ত সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানার গিয়াস উদ্দিন নামের এক বৃক্ষপ্রেমী ফরেস্ট কর্মকর্তার দোকানে দীর্ঘ কয়েক বছর কাজ করেছেন। ওই কর্মকর্তার সংস্পর্শে থেকে নার্সারি করার প্রেরণা পেয়েছিলেন প্রতাব চন্দ্র দাস। পরবর্তীতে এলাকায় ফিরে এসে নার্সারি করে তিনি শুধু নিজের বেকারত্ব-ই দূর করেননি, আশপাশের মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছেন। তিনি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার পান্ডারগাঁও ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের বাসিন্দা প্রয়াত প্রবাদ চন্দ্র দাসের সন্তান।
উপজেলার সর্ববৃহৎ চারা উৎপাদন ও বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান সুপ্তা নার্সারির স্বত্বাধিকারী প্রতাব চন্দ্র দাস ২০০৩ সালে সোনাপুর গ্রামের তার নিজ বাড়িতে মাত্র ২৫টি রেইনট্রি চারাগাছ দিয়ে নার্সারি শুরু করেন। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম অবস্থাতেই সফলতা পান।
পরবর্তীতে অল্প অল্প করে পরিধি বাড়ান। এভাবেই কয়েক বছরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ির আঙিনায় তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন উপজেলার সর্ববৃহৎ নার্সারি। তার বাড়ি জুড়ে সারিবদ্ধ প্যাকেট করা অসংখ্য চারাগাছ বৃক্ষপ্রেমীদের নজর কাড়ছে। এযেন অজোপাড়া গাঁয়ে একখন্ড সবুজ বিপ্লব।
২০০৮ সালে এই নার্সারিটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক সুপ্তা নার্সারি নামে লাইসেন্স প্রাপ্ত হয়। বসতবাড়ির আশপাশের ৯০ শতাংশ জমি নিয়ে বানিজ্যিক ভাবে গড়ে তুুুলা হয়েছে নার্সারিটি। আম, কাঠাল, কুুল, ভিয়েতনামী নারকেল, কামরাঙ্গা, লেবু, চামল, বেলজিয়াম, কদম, ইউক্যালিপ্টাস, রেইনট্রি, জলপাই, আমলকি, বহেরা, হরীতকী, অ্যালোভোরা, নিম, চালতা, তেতুল, লটকন, তেজপাতা, নাগামরিচসহ ৪৫ প্রজাতির প্রায় ৮০ হাজার বনজ, ফলজ, মসলা ও ঔষুধি গাছের চারা রয়েছে এখানে। প্রতিটি চারাগাছ তিন থেকে আটমাস বয়সী।
জানা যায়, গত মৌসুমে এখান থেকে প্রায় আড়াই লাখ টাকার চারা পাইকারি ভাবে বিক্রির করেছেন প্রতাব দাস। এই নার্সারি ব্যবসার ওপর নির্ভর করেই তার যাবতীয় সাংসারিক খরচসহ তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন।
পাশাপশি এলাকার ২০টি পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। সময়মতো বাজারজাত করতে পারলে আগামীতে চারা বিক্রি করে আরো প্রায় ৩ লাখ টাকা লাভবান হবেন বলে আশাবাদী তিনি। গত বন্যায় নার্সারির প্রায় ২০ হাজার চারাগাছ মারা যায়। এতে আর্থিক ভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কোনো ধরনের সরকারি প্রণোদনা না পেয়ে স্থানীয় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি।
নার্সারি ব্যবসার পাশাপাশি এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ডেও নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন প্রতাব দাস। ২০০৩ সাল থেকে টানা দুইবার বিপুল ভোটে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। তার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত আশপাশে আরো কয়েকটি নার্সারি গড়ে উঠেছে।
শুধু নার্সারি-ই নয়, পতিত জমি আবাদ করে উৎপাদন করছেন বিষমুক্ত শাকসবজি। নার্সারির পাশেই দোয়ারাবাজার উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তত্ত্বাবধানে ৩৩ শতক জমিতে সূর্যমুখী ফসলের প্রদর্শনী দেখা গেছে।
আলাপকালে সফল নার্সারি উদ্যোক্তা, সাবেক ইউপি সদস্য ও সুপ্তা নার্সারির স্বত্বাধিকারী প্রতাব চন্দ্র দাস প্রতিবেদককে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সবুজ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সরকারের এই উদ্যোগ সফল করতে আমি আমার অবস্থান থেকে কাজ করে যাচ্ছি।
আমার আশপাশের কোনো জমি পতিত অবস্থায় ফেলে রাখিনি। নার্সারি করে আমি এখন লাভবান এবং এটি একটি লাভ জনক পেশা। সরকারি চাকুরিজীবী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থী, বেকার যুবক যেকেউ চাইলে এপেশায় সম্পৃক্ত হতে পারে। আমি চাই সবাই নার্সারি করুক। আমি আমার নার্সারি আরো সম্প্রসারণ করতে চাই।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস আমাকে বিভিন্ন ভাবে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে আসছে। গত বন্যায় আমার কয়েক লক্ষাধিক টাকার চারা বিনষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমি কোনো প্রণোদনা পাইনি। নার্সারি উদ্যোক্তারা প্রণোদনাসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে নার্সারির প্রসার ঘটবে।
পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের দোয়ারাবাজার উপজেলা শাখার মাঠ সহকারী সোহেল আমহদ জানান, প্রতাব দাস আমাদের সমিতির সদস্য। তার নার্সারি আমরা পরিদর্শন করেছি এবং নার্সারি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সম্প্রতি আমরা তাকে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
দোয়ারাবাজার উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসিন জানান, আমাদের অফিসের লোকজন প্রতাব দাসের নার্সারি পরিদর্শন করেছে। তার সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে। গত বন্যায় তার নার্সারি ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখন আবার ঘুরে দাড়িয়েছেন তিনি।
সরকারিভাবে কৃষকদেরকে কৃষি প্রণোদনা দেওয়া হলেও নার্সারি উদ্যোক্তাদের কোনো ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবে তারা চাইলে কৃষি লোনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। আমরা তাকে একটি প্রদর্শনী দিয়েছি। বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করছি। তার এই নার্সারি বেকার যুবকদের প্রেরণা যুগাবে।
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি