সব
সিলেট নগরবাসীর শেষ ঠিকানা নগরীর হযরত মানিক পীর (রহ.) গোরস্তান। এখানে অন্তীম শয়ানে অগণিত মানুষ-সকলেরই শেষ ঠিকানা এটি। কতোজন যে এখানে সমাহিত, সঠিক কোনো হিসেব কারোর কাছেই নেই। গত বছরের এপ্রিল থেকে এখানে উন্নয়ন কাজে হাত দিয়েছে সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক)। উন্নয়ন কাজের ধারাবাহিকতা বছর পেরিয়ে দুই বছরে গড়িয়েছে। কিন্তু উন্নয়ন কাজ শেষ হচ্ছে না। উন্নয়ন কাজের নির্মমতা দীর্ঘদিন ধরে নগরবাসীকে চরমভাবে আহত করেছে। এবার নতুন করে আবার আহত করলো নগরবাসীকে। এবার সিসিক সরাসরিই কবরে হাত দিয়েছে। প্রায় হাজারো মানুষের কবর খুঁড়ে ফেলে তারা নির্মাণ করছে গার্ডওয়াল। যা নগরবাসীকে চরমভাবে ব্যথিত করেছে। অনেক স্বজনেরই দীর্ঘশ্বাস চাপা পড়েছে এই দেয়ালের নিচে।
সোমবার ও মঙ্গলবার সরেজমিনে মানিকপীর কবরস্থানে গিয়ে দেখা গেছে বি-ব্লক অংশের মাঝখানের অংশে থাকা কবরগুলো খুঁড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে গার্ডওয়াল। এতোটাই গভীরভাবে গর্ত করে গার্ডওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে যে কারণে নিচে থাকা কবরগুলোর হাড়গোড় একটি অন্যটির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। যুগের পর যুগ এই অংশতেই হাজার হাজার মানুষকে দাফন করা হয়েছে। গার্ডওয়ালের দক্ষিণ দিকে থাকা হাজার হাজার কবরকে ফেলে দেয়া হচ্ছে অনিশ্চয়তায়। গার্ডওয়াল দিয়ে উত্তরাংশকে সংযুক্ত করে নেয়া হচ্ছে বি ব্লকের ভিতরে। আর দেয়ালের বাইরের দিকটা থাকছে উন্মুক্ত। যা একটা সময় পরিণত হবে মানুষের পার্কিং প্লেসে। যেখান থেকে কবরগুলোর উপর দিয়ে প্রতিনিয়তই মানুষের থাকবে অবাধ চলাচল। যার কারণে নষ্ট হবে কবরের পবিত্রতা। একটা সময় পর কবরগুলোর আর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। যেমনটি ঘটেছে এ ব্লক অংশে। যেখানে ব্লক উদ্বোধনের পর গার্ডওয়ালের পর দক্ষিণ দিকটাকে রেখে দেয়া হয়েছে উন্মুক্ত। যাতে এখন মানুষজন মোটরবাইক পার্কিং করে রাখেন। ময়লা আবর্জনাসহ অপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র ও নির্মাণসামগ্রী রাখা হচ্ছে।
এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় একেরপার এক কবর খুঁড়ে তার উপরে গার্ডওয়াল নির্মাণ করার প্রস্তুতি চলছে। ত্রিপল দিয়ে আঁড়াল করে চলছে নির্মাণকাজ। কবর জিয়ারত করতে আসা নুরুল হুদা চৌধুরী কায়েস বলেন, ‘এ বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। সিসিক কবরস্থানের ভিতরেই গভীর গর্ত খুঁড়ে গার্ডওয়াল নির্মাণ করছে। যা অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। আমরা চাই আমাদের প্রয়াত আত্মীয়-স্বজনদের কবর ভালো থাকুক। সকলের কবরের পবিত্রতা রক্ষা হোক। উন্নয়ন কাজে আমাদের কোন আপত্তি নেই। তবে এটি নিয়মমতো ও পবিত্রতা রক্ষা করে অবশ্যই করতে হবে। নতুবা আমরা পুরো নগরবাসীকে নিয়ে আন্দোলনে নামবো।’
হযরত মানিক পীর কবরস্থানে উন্নয়ন নিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের অপরিকল্পনা, অদক্ষতার কারণে এর আগেও মানুষ ব্যথিত হয়েছেন। এর আগেও এখানে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে এক্সকেভেটর দিয়ে কবরগুলোকে ড্রেসিং করা হয়েছে। এক্সেকেভেটরের আঘাতে এখানে একজনের কবরের সাথে অন্যজনের কবরের মাটি, হাড়গোড় সব এক হয়ে গিয়েছিল তখনও। এক্সকেভটর দিয়ে অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে উপড়ে ফেলা হয়েছে কবরের সব নামফলক। এতে মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটেছে। এমন অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ড ঘটানোর পর কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘তারা নতুন কোন কবরের উপর দিয়ে এক্সকেভেটর চালাননি।’
কিন্তু গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পরও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নিরব ভূমিকা ছিল। দায় এড়াতে তারা কবরের দেয়াল ঘেঁষে ত্রিপল টানিয়ে দিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় বি ব্লকে এসে হাজারো মানুষের কবরের উপর গভীর গর্ত খুঁড়ে দেয়াল নির্মাণ করছে তারা।
স্বজন হারানো নাগরিকদের মধ্যে যুবলীগ নেতা ও ব্যাংক কর্মকর্তা তারেক আহমদ চৌধুরী বলছেন, ‘উন্নয়নকাজ হোক, কিন্তু মানুষের আবেগে আঘাত করে উন্নয়ন চাই না। মানুষের কবরের মাটি উপড়ে গর্ত খুঁড়ে গার্ডওয়াল নির্মাণ এবং কবরের উপরে পার্কিংপ্লেস নির্মাণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমরা আমাদের সাধ্যমতো প্রতিবাদ জানাবো। আশাকরি কর্তৃপক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।’
প্রসঙ্গত, হযরত শাহজালাল (রাহ.) দরগাহ গোরস্তানের চেয়েও মানিক পীর (রাহ.) টিলায় বেশি মানুষকে সমাহিত করা হয়েছে। যা স্বাভাবিকভাবেই চোখ ফেললে অনুধাবন করা যায়। এমন দিন খুবই বিরল যে এখানে নতুন কোন কবর হয়নি। আর এসব কারণে গোরস্তানটির গুরুত্ব অসামান্য। নগরে এমন কোন ঘর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যে মানিক পীর (রাহ.) টিলাতে তাদের কাউকে সমাহিত করা হয়নি।
২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে নগরভবন কর্তৃপক্ষ আকস্মিক নগর গোরস্থানের সকল বেড়া তুলে নেন। তখন নগরভবনের জনসংযোগ বিভাগ বিজ্ঞপ্তিতে বলে, ‘সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কবরস্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, হেলে পড়া গাছকর্তন ও ছাটাই, রঙ করে সৌন্দর্যবর্ধন চলছে। কবরস্থানে মাটিভরাট, গোসলখানা সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে।’ এরপরই উন্নয়ন কাজ শুরু করে সিটি কর্পোরেশন। তখন থেকেই মানুষের কবরস্থানের উপর দিয়ে এক্সকেভেটর চালিয়ে করানো হয় মাটি ভরাটের কাজ। মানুষ বিভিন্নভাবে এক্সকেভেটর দিয়ে কবরের উন্নয়ন কাজ পরিচালনা করায় নিন্দা জানিয়ে আসেন। বিভিন্ন দায়িত্বশীলদের সাথে বিষয়টি আলোচনাও করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এক্সকেভেটর থেকে সরেনি। সেটি অব্যাহত রাখে। মানুষের চোখকে আড়াল করতে ত্রিপল টানানো হয়।
কাজীটুলা, উত্তর কাজীটুলা, কুমারপাড়া, নয়াসড়ক, মীরবক্সটুলাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের দাবি, ‘আমরাও উন্নয়ন কাজ চাই। আমরাও চাই সৌন্দর্যবর্ধন হোক। কবরস্থানকে অবজ্ঞা করে, অপমান করে উন্নয়ন আমরা চাই না। আমরা মেয়রসহ অন্যদের প্রতি অনুরোধ জানাবো বি ব্লক অংশের পুরোটাই মূলকবরের সাথে সংযুক্ত রাখা হোক। কেননা যুগ যুগ ধরে এখানে কয়েক হাজার মানুষকে দাফন করা হয়েছে। এখন গার্ডওয়াল নির্মাণ করে যদি কবরগুলোকে উন্মুক্ত করে দেয়া হয় তখন সেটির পবিত্রতা ক্ষুন্ন হবে। যা নগরবাসী কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। মেনে নিবে না। প্রয়োজনে বি বøকের জন্য নতুন করে প্ল্যান তৈরি করার অনুরোধও তাদের। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে এই অংশটি চলে যাবে মূলরাস্তার সাথে। তখন আর কবরের অস্তিত্বই থাকবে না।’
উত্তর কাজীটুলা এলাকার বাসিন্দা মিফতাহ উদ্দিন জানান, ‘আমার দুই চাচা, দাদির কবরের উপর নির্মাণ করা হচ্ছে গার্ডওয়াল। সোমবার গিয়ে সরেজমিনে দেখা যায় কবরগুলো খুঁড়ে গভীর গর্ত করে নির্মাণ করা হচ্ছে গার্ডওয়াল। যা অত্যন্ত কষ্টের। আমি মেয়র ও কাউন্সিলরসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে অবিলম্বে বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ জানাচ্ছি। অন্যথায় আমরা আন্দোলনে নামবো।’
সৌজন্য : দৈনিক একাত্তরের কথা
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি