টিনের বাঁশী (পর্ব-২)

আজিজুজ সামাদ ডন;
  • প্রকাশিত: ৩০ জুলাই ২০২০, ৯:২০ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ৪ বছর আগে

সঞ্চালকের শেষ কথাটি কেন যেন ক্যামেরাম্যানের গায়ে লাগলো, বললেন,
-সারা জীবন ঘর-সংসার করেও যেখানে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে পুরোপুরি চিনতে পারে না, সেখানে আপনার সাথে পরিচয়কে খুব বেশী হলে চলার পথে ক্ষণিক দেখা বলতে হয়। প্রতিটি মানুষই ইউনিক, অনন্য, তুলনাহীন এবং একজনের সাথে আরেকজনের তুলনা বাতুলতা মাত্র।

ডাক্তার তো তত্বকথার ভান্ডার, চুপ থাকার পাত্র নন,
-ফ্রয়েডের জন্মতত্ব অনুযায়ী আপনার জন্মটাই নন-এক্সিস্টান্যান্ট বা আপনি অস্তিত্বহীন একটি শুন্য। সেটার সাথে যোগ করুন, মানুষের বেড়ে ওঠার পরিবেশের ভিন্নতা। সব মিলিয়ে, যদি মানুষের পুণর্জন্ম হয় তাহলে হাজার জন্মেও একজন আরেকজনের যায়গায় পৌঁছাতে পারবে না। সেখানে আপনার সমালোচনা করার জন্য দিন-ক্ষণ নির্ধারন করছেন কিভাবে কিংবা আরেকজনের মননশীলতার প্রতি কটাক্ষ করছেন কোন যুক্তিতে।

কথার ফাঁকে আমি দৃষ্টি বুলিয়ে যাচ্ছি সকলের প্রতি। জমিদার নন্দনকে দেখে মনে হল সুযোগ খুঁজে চলেছে কোন সময় সে দাঁড়িয়ে যাবে। ইঞ্জিনিয়ারের চেহারা দেখে মনে হল, এই প্রথম তার পক্ষ নিয়ে সকলে সঞ্চালককে আক্রমন করায় সে প্রচন্ড খূশী। ডাক্তারের ভাবভঙ্গিতে একটা নির্লিপ্ত ভাব সব সময়ই কাজ করে, আজও সেটার কোন ব্যতিক্রম নেই। সঞ্চালক চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে আছেন মনে হলেও চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি মওকা খুঁজে চলেছেন কিভাবে কোন কথার ফাঁক গলে আজকের এই আক্রমন থেকে নিজেকে বের করে আনবেন। কিন্ত ক্যামেরাম্যানকে কেন যেন আজ সব কিছুর ওপরই বিরক্ত মনে হল, বললেন,
-আপনার কথা বার্তা গুলো আজ কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে। একটা কথা কিন্ত ঠিক, দম্ভ এবং নিজের প্রতি নিজের অতিরিক্ত আস্থা বিপদ ডেকে আনে।

লেখক- আজিজুস সামাদ আজাদ ডন

ক্যামেরাম্যানের কথার মাঝেই সঞ্চালক তার ধ্যান ভেঙ্গে নড়েচড়ে বসায় বুঝে নিলাম তিনি যে সুযোগের সন্ধ্যানে ছিলেন সেটা পেয়ে গিয়েছেন, বললেন,
-“বিপদ” শব্দের আভধানিক অর্থ যাই হোক না কেন আমি মনে করি বিপদ শব্দটি মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ের তৈরী করা অনিশ্চয়তা। অন্ধকারের মাঝে আপনার দৃষ্টিশক্তির অক্ষমতার কারণে মানুষের মাঝে যে অনিশ্চয়তা বোধ সৃষ্টি করে, সেখান থেকেই মানুষের মাঝে একটা ভয় তৈরী হয় কিন্ত তার মানে এই নয় যে মানুষ অন্ধকারকে ভয় পায়। মৃত্যুর ভয় কে জয় করা কি মানুষের পক্ষে সম্ভব, যেখানে মৃত্যু সম্পর্কে মানুষের কাছে কোন তথ্যই নেই। রাস্তা পারাপারের সময় চারদিক দেখে মানুষ নিশ্চিত হয় যে, ঠিক ঐ সময়ে রাস্তা পার হলে সে কোন দুর্ঘটনায় পরবে না, অথচ, ঠিক তার এক সেকেন্ড পরেই হয়তো সেখান দিয়ে একটি ট্রাক দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে, অর্থাৎ, মৃত্যুর সাথে তার দুরত্ব মাত্র এক সেকেন্ড, সেটা কি সে কখনো ভাবে। আমরা সকলে কোরবানীর গরুর মত আচরণ করে চলেছি, পাশেই তার জাত ভাইকে জবাই করা হচ্ছে অথচ সে নিশ্চিন্ত মনে জাবড় কেটে চলেছে, যেন ওটা তার বিষয় নয়। আপনাকে কে নিশ্চিত করেছে যে, এই মুহুর্তে একটা ভয়াবহ ভুমিকপম্পে সব ধ্বসে পরবে না, আমরা সকলে মারা যাবো না?

জমিদার নন্দন আর থাকতে পারলো না। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার জুড়ে দিল,
-আমি বুইঝা ফেলিয়াছি আমি বুইঝা ফেলাইছি, সঞ্চালক সাহেব আমাদের ভয় দেখাইয়া নিজেরে বাঁচাইতে চাহিতেছেন। প্রতিবাদ তীব্র প্রতিবাদ…..

সঞ্চালক রীতিমত ধমকের স্বরে বলে উঠলেন,
-আপনে কিছুই বুঝেন নাই, কথার মাঝখানে কথা বলে আপনি আমার মুখ বন্ধ করার চেষ্টায় আছেন, বসলে ভাল লাগে।

আমি ততক্ষণে মনে মনে অডাসিটি শব্দটির বাংলা অর্থ খুঁজে চলেছি। হঠাৎ মনে পরে গেল। আসলেই সঞ্চালকের কথা গুলো আজ বেশ ধৃষ্টতাপূর্ণ। হয়তো অফেন্স ইজ দা বেস্ট ডিফেন্স ভেবে তিনি এই আচরণ করে চলেছেন অথবা আমরা ওনাকে কুপোকাৎ করতে পারছিনা বিধায় ওনার কথা গুলোকে ধৃষ্টতাপূর্ণ মনে করছি। আমারা ভাবনার অনুরণণ ফুটে উঠলো ডাক্তারের তীক্ষ্ণ স্বরের পরবর্তি প্রশ্নে,
-আপনার কথা কি তাহলে এখনো শেষ হয়নি?

সঞ্চালক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন,
-অবশ্যই শেষ হয়নি। এক এটোমিক ফিউশনের শক্তি আবিষ্কার করেই বিশ্বকে হাজারবার ধ্বংসের শক্তি তৈরী করে বিশ্বের মোড়লেরা যে ভাবে মনে করছে “আমি কি হনুরে”, সেখানে গ্লুয়োন, ফারমিওন, হিগসবোসনকে ব্যাখ্যা করে কোয়ার্ক শক্তির কাছে পৌঁছে গেলে কি হবে কেউ এখনো জানে না। অথচ, সেটাই যে শেষ কথা হবে এটাও নিশ্চিত নয়। সেই অনিশ্চয়তা আপনার কাছে বিপজ্জনক মনে হচ্ছে না কেন? একক সৃষ্টি কর্তার এই বিস্ময়কর শক্তির একক আঁধার থেকে সৃষ্ট মহাজাগতিক সৃষ্টি রহস্যার কথা একবারও কি আমাদের চিন্তায় কাজ করে। আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রীয় দ্বারা সংগৃহিত তথ্য সমুহের উপর ভিত্তি করে ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ের সৃষ্ট এই বিশ্বকে নিয়ে এতোটা নিশ্চিত হচ্ছি কেন। ক্যামেরাম্যান ফ্রয়েডের রেফারেন্সে বললেন “আমি” অস্তিত্বহীন কিন্ত সমস্ত মহাজগতই একটি শক্তির বিভিন্ন প্রতিরূপ মাত্র এবং সেই সূত্রে অস্তিত্বহীন সেটার কথা ভুলেই যাচ্ছি মনে হচ্ছে।

এবার আর জমিদার নন্দন নন, ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
-আমার আজ কাজ আছে, আমাকে বিদায় নিতে হচ্ছে।

আমি বললাম,
-সেকি, ভাবীর পাঠানো খিচুরি মিস করবেন।

ডাক্তার বললেন,
-উপায় নেই, ডিউটি কলস। করোনার এই মহামারীর সময় আমাদের কোন শুক্র-শনি নেই। ভাবীকে ফোন দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেবো ক্ষণ।

জমিদার নন্দন এবার বসে থেকেই বললেন,
-তাহা হইলে ক্লাব বন্ধ করার স্বৈরাচারী ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আপনার ভোট নিশ্চিত করিয়া যান।

ডাক্তার সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য হাঁটা শুরু করে দিয়েছিলেন, জমিদার নন্দনের কথায় থমকে দাঁড়ালেন,
-ষড়যন্ত্র কোথায় পেলেন। উনি যা বলেছেন সেটা আমি নিজ কানে শুনেছি। ওনার কথায় মনে হয়েছে উনি আগামী কিছুদিন ক্লাবে আসবেন না বলে জানিয়েছিলেন। ওনার না আসবার সম্ভবনার কারণে ক্লাবের আড্ডা তো থেমে থাকেনি। আমরা তো ঠিকই এসেছি। ব্যক্তির থাকা না থাকায় একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায় না। বরং আমি বলবো, ওনার কথার কারণে প্রমান হয়েছে যে, আমাদের ক্লাব এখন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত হল।

ডাক্তার চলে যাচ্ছেন দেখে পেছন থেকেই সঞ্চালক বলে উঠলেন,
-এই রকম একটা দারুন কথার জন্য ডাক্তার সাহেবকে ধন্যবাদ। আমি কি পাগল নাকি যে আমাদের স্যাটারডে ক্লাবের মত একটি প্রতিষ্ঠানকে নিজের হাতে ধ্বংস করবো।

সঞ্চালকের ধমক খেয়ে জমিদার নন্দন আর চেয়ার ছেড়ে উঠতে রাজি নন বোধহয়, বসে বসেই খুব আনুষ্ঠানিক এবং গম্ভীর ভাবে সঞ্চালকের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন,
-তাইলে আপনি বলিতে চাইতেছেন, সুযোগ থাকলে পাগল সাজিয়া আপনি স্যাটারডে ক্লাব ধ্বংস কইরা ফেলিতেন।

ডাক্তার সাহেবের সময় নেই, চলে যাচ্ছেন দেখে তাড়াতাড়ি সঞ্চালক বললেন,
-ডাক্তার সাহেব, এক মিনিট। যাবার আগে জমিদার নন্দনের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে একটি চুটকী শুনে যান। একবার স্ত্রী স্বামীকে জিজ্ঞেস করছে, “আচ্ছা, আমি মারা গেলে তুমি কি করবে?” স্বামী খুব আবেগ নিয়ে বললো, “আমি পাগল হয়ে যাবো”। স্ত্রী বললো, “সেটা তো বুঝলাম, কিন্ত আমি মারা গেলে কি তুমি আরেকটা বিয়ে করবে?” স্বামী উত্তর দিল, ‘পাগলে কিনা করে”।

চুটকী শুনে আমাদের কারো হাসি পেলো না, ডাক্তার শুধু মুচকী হেসে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছেন দেখে ডাক্তারকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বলে উঠলেন,
-তাইলে সিদ্ধান্ত ফাইনাল, স্যাটারডে ক্লাব অদ্য হইতে একটি প্রতিষ্ঠান, কোন পাগলে সেইটা ভাঙ্গতে পারবোনা এবং সেই প্রতিষ্ঠানের আজীবন হুদাহুদি সভাপতি আমি।

ডাক্তার চলে যেতে যেতে দরোজার সামনে থেকে বললেন,
-আমার ভোট আপনার প্রস্তাবের পক্ষে দিয়ে গেলাম।
(চলমান)

 

 

প্রিয় পাঠক, আপনিও সিলেটডায়রি’র অংশ হয়ে উঠুন। স্বাস্থ্য, শিল্প ,সাহিত্য, ক্যারিয়ার, পরামর্শ সহ যেকোন বিষয় নিয়ে লিখুন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ মেইল করুন sylhetdiary@gmail.com-এ ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি