টিনের বাঁশী (পর্ব-১)

আজিজুস সামাদ আজাদ ডন;
  • প্রকাশিত: ২৯ জুলাই ২০২০, ৭:১৬ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ৪ বছর আগে

দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বিশাল দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে পরের শনিবার স্যাটারডে ক্লাবে হাজির হলাম। দূঃখবোধ এবং দুশ্চিন্তার সূত্রটা লুকিয়ে ছিল বিগত শনিবারে সঞ্চালক মহোদয় ক্লাবের সভা অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করার মাঝে। কিন্ত নাহ, ক্লাবে যেয়ে দেখি, প্রায় ফুল হাউজ, নিয়মিত সদস্যরা প্রায় সকলেই আছেন। ইঞ্জিনিয়ার তো থাকবেনই, যেহেতু ক্লাবটা ওনার অফিসেই, সাথে ডাক্তার, জমিদার নন্দন, ক্যামেরাম্যান চুটিয়ে আড্ডা মারছেন। আমিও খুশী মনে কেবল চেয়ার টেনে নিয়ে বসেছি মাত্র, সাথে সাথেই দেখি দরোজার সামনে সঞ্চালক। আমার আর বসা হলো না, অতি আবেগে সবাই দাঁড়িয়ে বললাম,
-শুভেচ্ছা স্বাগতম, স্যাটারডে ক্লাবে আগমন।

সঞ্চালকের চেহারায় বিগত দিনের রাগ-ক্ষোভের কোন ছাপ নেই। মুচকী একটি হাসি ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে রেখে চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললেন,
-আমাদের ক্লাবে আপনারা আমাকে আলাদা ভাবে এমন ঘটা করে আগমনী শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন কেন? নাকি ক্লাব আজ থেকে সকলকেই এভাবে শুভেচ্ছা জানাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ছোট খাটো গড়নের জমিদার নন্দন তখনো বসেনি, বেশ উত্তেজিত ভঙ্গীতে বক্তৃতা দেয়া শুরু করলেন,
-আপনে নাকি গত শনিবারে ক্লাবের সভা অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করিয়া গেছেন। আমরা আমাদের গনতান্ত্রিক ক্লাবে কোন স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত মানি না। ইঞ্জিনিয়ারে ফোন দিয়া কইলো এই বিষয়ে আলোচনা হইবে, চলিয়া আইলাম, কিন্ত আপনের সিদ্ধান্ত আবার আপনে স্থগিত করিয়া বুঝাইয়া দিলেন, কেন কোন স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তই ভাল না।

ইঞ্জিনিয়ার আজ সুযোগ পেয়েছে সঞ্চালককে খোঁচাবার, সুযোগ হাতছাড়া করবার কোন কারণ নাই,
-হুহ, হেতেরও সিদ্ধান্ত, হেতেও আবার স্বৈরাচার। ওনারে স্বৈরাচার কইয়া আপনেরা স্বৈরাচার শব্দটার আভিধানিক অর্থই বদলাইয়া দিতেছেন।

জমিদার নন্দন আসলে সুযোগ পেলেই দাঁড়িয়ে যান। আমার মনে হয় ওনার নিজের উচ্চতা নিয়ে নিজের মাঝে একটি কম্পলেক্সিটি কাজ করে বলেই এটা করেন। আসলেই আমরা সকলে বসে থাকলেও ওনার দাঁড়ানো অবস্থার চেয়ে সমান বা একটু বেশীই হব। উনি দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন,
-ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কথার আমি তীব্র প্রতিবাদ করিয়া বলতে চাই, আপনি ইচ্ছাকৃত ভাবে বাক্যের মাঝে অভিধান টভিধান মার্কা শব্দ লাগায়া জটিলতা তৈয়ার করিবার মাধ্যমে পক্ষপাত দুষ্ট আচরন করিয়া আমাদের আন্দোলন প্রশমিত করিবার চেষ্টা করতেছেন।
জমিদার নন্দনের উদ্ভট ভাষা প্রয়োগ ডাক্তারের আর সহ্য হলো না,
-আপনি সাধু-চলিত মিশিয়ে এসব কি বলছেন।

জমিদার নন্দন বললেন,
-আমি লক্ষ করছি, আমাদের লেখক মহোদয় কোন ব্যাঙ্গাত্নক লেখা লেখলেই সাধু ভাষায় লেখে, সেইখান হইতে আমি সিদ্ধান্ত লইয়াছি, স্যাটায়ার করিতে চাহিলে সাধু ভাষা প্রয়োগ করবো।

ক্যামেরাম্যান এতোক্ষণ চুপচাপ বসে বসে বোধহয় মনের ক্যামেরায় আমাদের ছবি তুলছিলেন, নিরবতা ভঙ্গ করে বললেন,
– আপনি এতোক্ষণ সঞ্চালককে নিয়ে ব্যাঙ্গ করলেন নাকি!! আমি অন্তত আপনার কথায় কোন ব্যাঙ্গ খুঁজে পাইনি।
জমিদার নন্দন একটু হতাশা নিয়ে ধপাস করে বসে বললেন,
-ঐটা তাইলে শিক্ষক, মানে, লেখক সাহেবের দোষ, নাইলে আমার চর্চার অভাব, তবে এই যে আন্দোলন আন্দোলন খেললাম এইটা স্যাটায়ার হয় নাই নাকি?

ডাক্তার রায় দিলেন,
-আমিও আপনার কথায় সঞ্চালককে ব্যাঙ্গ করার কোন উপকরণ খুঁজে পাইনি, সুতরাং, চর্চা ছাড়া কোন কিছুরই প্রায়োগীক উপযোগীতা নেই।

জমিদার নন্দন একটু মনক্ষুন্ন ভাবে ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-উক্ত বিষয়ে আপনারও কি একই রায়।
ইঞ্জিনিয়ারের নিরবতাকে সম্মতি ধরে নিয়ে জমিদার নন্দন বললেন,
-ঠিক আছে, মেজোরিটি রুলস। আপনাদের সকলেরই যখন একই রায়, তখন ধরিয়া নিতেছি আমি রায় পাইয়া গিয়াছি। লেখক মহোদয় কে আনুরোধ করব, আমার নাম এখন হইতে “জমিদার নন্দন রায়” লিখবেন।

ইঞ্জিনিয়ারের আর সহ্য হচ্ছিল না। সঞ্চালক কোন কথার উত্তর দিচ্ছেন দেখে উনি মনে করে নিলেন আজ সঞ্চালককে বাগে পেয়েছেন, আরও আক্রমনাত্নক ভাবে শব্দবাণ ছুড়ে দেবার চেষ্টায় বললেন,
-আরে ফেলান মিয়া আপনাগো এই সব রায় ফায়। সঞ্চালকের মুখের কথার কোন দাম নাই, ক্লাবে আইছে কেন সেইটার উত্তর দেওয়া লাগবো আজকে। স্বৈরাচারী আচরন কইরা ক্ষমতা ছাইড়া মাত্র এক হপ্তাতেই নিঃসঙ্গতায় ভুগতেছে কইয়া যদি আইসা থাকে তাইলে আমিও জমিদার নন্দন রায়ের মত আন্দোলন আন্দোলন খেলায় যোগ দিমু।

সঞ্চালক এতোক্ষণে মনে হয় সুযোগ পেলেন কথা বলার, আমার দিকে তাকিয়ে তার স্বভাব বিরুদ্ধ খুব মোলায়েম স্বরে প্রশ্ন করলেন,
-ভাই, মিস্তিরী কি আজকে আপনাদের চা-সিঙ্গারা কিছু খাইয়েছে?
আমি “না” বলতেই উনি একেবারে তেড়েফুড়ে বললেন,
-তাইলে মিস্তিরী ব্যাডারে এতো বড় বড় কথার অনুমতি কে দিল।

ইঞ্জিনিয়ারও আজ এতো সহজে হাল ছাড়বেন না,
-আইজ হুদা সিঙ্গারা-কফি না শুধু, খিচুরি, ডিম ভাজিও খাওয়ামু। বাসা থেকে আমার ওয়াইফ খিচুরি-ডিমভাজি পাঠায়া দিছে সকলের লাইগা। সালাম মিয়া, ও সালাম মিয়া, সিঙ্গারা আরা কফি খাওয়াও সকলেরে আর খিচুরি রেডি কর।

সঞ্চালক একটা মুচকী হাসি দিয়ে শুরু করলেন,
-আমি না থাকলে আপনাদের যে কি হতো, চা-সিঙ্গারা কিছুই কপালে জুটতো না। যাক, এই বিশ্বে প্রতিটি মানুষ জন্ম থেকেই নি:সঙ্গ, এসেছে একা, যেতেও হবে একা। মাঝের কিছু সময়ে একটা ইলুইশন তৈরী হয় যাকে “আদত ” বা অভ্যাস দিয়ে ডিফাইন করতে পারেন। ক্ষমতার অভ্যাস বলেন আর দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসের কথাই বলেন, ছেদ পরলে বুকের মাঝে একটা খালি খালি ভাব তৈরী হবেই। ওটাকে যদি আপনারা নিঃসঙ্গতা বলতে চান তবে আমার উত্তর, হ্যা, নি:সঙ্গতার কারণেই এসেছি। তবে আমি এসেছি অন্য কারণে। এটা আমাদের ক্লাব, আমাদের প্রাথমিক সিদ্ধান্তই ছিল এখানে ধর্মীয় এবং সরাসরি কোন রাজনৈতিক আলাপ চলবেনা। ক্লাবকে আদর্শচ্যুত হতে না দেয়ার তাগিদ থেকে আমি এসেছি।

জমিদার নন্দন আবার দাঁড়িয়ে হাত-পা ছুড়ে বলা শুরু করলেন,
-মানি না মানবোনা। আদর্শ, স্বৈরাচার, আন্দোলন এই সকল শব্দই রাজনৈতিক শব্দ। উনি নিজেও আদর্শ শব্দটি বলা মাত্রই উহা রাজনৈতিক আলাপ হইয়ে গেল। আমাদের আদর্শচ্যুত করার কারণে তিনির বিরুদ্ধে আমি অনাস্থা প্রস্তাব আনিলাম।

আমরা কিছু বলার আগেই সঞ্চালক বলে উঠলেন,
-নতুন নতুন রায় পাইছেন তো, কিসের রায় বুইঝা উঠতে পারেন নাই। এই যে আপনি কথায় কথায় দাঁড়িয়ে যান, সেটাতে কি আপনি আমাদের চেয়ে লম্বা হয়ে যাচ্ছেন নাকি। শব্দের আবার নিজস্ব কোন গুন-মান থাকে নাকি। শব্দের প্রয়োগের মাঝে গুন-মান নির্ধারিত হয়। যে কারণে জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ বারেবারে জিহ্বার ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেছেন। মানুষের হাত, পা, নাক, কান প্রায় সব কিছুই বহুবচনে দেয়া হয়েছে কিন্ত মুখ এবং জিহ্বা মাত্র একটি। সুতরাং খাওয়া এবং কথা বলায় সাবধানতা অবলম্বনের নিদর্শন সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টির মাঝেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। মুখের মুহুর্তের ব্যবহারজনিত কারণে নায়ক-খলনায়ক তৈরী হয়।

ডাক্তার এবার সঞ্চালককে আক্রমনের দায়ীত্ব নিয়ে বললেন,
-আপনার কথা অনুযায়ী তো তাহলে প্রতি মুহুর্তে নায়ক-খলনায়ক তৈরী হয়ে চলেছে; কিন্ত ইতিহাসের পাতায় তো সেটার রিফ্লেকশন নেই।

সঞ্চালক এতোক্ষণে মনে হয় বুঝেছেন আজ তিনি ক্লাবের সকলের রোষানলে জ্বলবেন, সেকেন্ড খানেক সময় নিয়ে বলা শুরু করলেন,
-প্রতিটি পরিস্থিতিতে একেকজন ক্ষণের নায়ক বা খল-নায়ক হচ্ছেন, আবার নিকট ইতিহাস জন্ম দেয় সেই কালের নায়ক, আর বহু কালের সম্মিলিত ইতিহাস তৈরী করে মহানায়ক, জন্ম নেন শত বা হাজার বছরের ইতিহাসের পাতার একেকটি স্বর্ণ খচিত নাম। এই ক্ষণে এই পরিস্থিতিতে আপনারা সবাই আমাকে খলনায়ক ভাবছেন আর আপনারা আপনাদের বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জরিত করে নিজেদের এই ক্ষণের নায়ক ভাবছেন। কিন্ত ক্লাবের ইতিহাস যদি লেখা হত তাহলে কি আলাদা করে আজকের অধিবেশন কেন্দ্রীক আমার উত্তর বা আপনাদের প্রশ্নের বিচারে ক্লাবের নায়ক বা খলনায়ক চিহ্নিত হত?

ইঞ্জিনিয়ার বলে উঠলেন,
-এইটা ডিজিটাল যুগ, সিধা লাইভ কইরা জনমত তৈরী করুম।

সঞ্চালক বললেন,
-আমাদের এই আলোচনা ডিজিটাল মাধ্যমে কিছু সাধারণ মানুষের কাছে লাইভে পৌঁছে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে ক্ষণিকের একটা জনমত তৈরী করার উদ্যোগের মাঝ দিয়ে ক্লাবের ইতিহাস অন্য ভাবে লেখার চেষ্টা আর বোকার স্বর্গে বসবাস সমার্থক।

কথা গুলো প্যাঁচালো, আমি কিছুই বুঝলাম না কিন্ত ইঞ্জিনিয়ার হাল ছাড়ার পাত্র নন, কি বুঝলেন জানিনা, বললেন,
-হেতে কিন্ত নিজেরে ক্লাবের ইতিহাসের মহানায়ক ভাবতেছে, আপনেরা বুইঝছেন নি।

এইবার সঞ্চালক তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
-ক্লাবের মহানায়কই যদি নিজেরে ভাবতাম তাইলে তোমার এই কথার উত্তরই দিতাম না। তোমার মত টিনের বাঁশীর মেটালিক সূরামৃত মার্কা পংক্তি মালা দিয়ে কালের ইতিহাসের সুরমূর্ছনায় কোন ব্যত্যয় ঘটাতে পারবে অথবা একজন সত্যিকারের নায়ক বা মহানায়কের গায়ে নুন্যতম আচড় লাগাতে পারবে সেটা অসম্ভব অলীক কল্পনা মাত্র। তুমি এখনো সেই যায়গায় পৌঁছাও নাই যেই যায়গা থেকে আমার সমলোচনা করতে পারো।
(চলমান)

 

 

প্রিয় পাঠক, আপনিও সিলেটডায়রি’র অংশ হয়ে উঠুন। স্বাস্থ্য, শিল্প ,সাহিত্য, ক্যারিয়ার, পরামর্শ সহ যেকোন বিষয় নিয়ে লিখুন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ মেইল করুন sylhetdiary@gmail.com-এ ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।

শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও খবর...

পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি