সব
একটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘিরে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে নানা কথা ডালপালা মেলেছে। এই ঘটনায় প্রথমে মামলা হয়নি এক সপ্তাহে। এ নিয়ে মাতামাতি হয় অনেক। পরে মামলা হয়, গ্রেপ্তার করা হয় এজাহারনামীয় তিন আসামিকেও। আটক হন মামলার এক স্বাক্ষীও। বর্তমানে তারা রয়েছেন কারাগারে। আর এই ধর্ষণের ঘটনার মূল গল্পের খোঁজ করতে গিয়ে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ বেরিয়ে এসেছে।
চলতি বছরের ২৪ জুন হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার দারাগাও চা বাগানের পাকা লাইন এলাকায় ১৫ বছরের এক সাঁওতাল স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। ওই দিন চুনারুঘাট থানায় একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন ওই কিশোরীর মা। মামলার এজাহার অনুযায়ী ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছিলো ১৬ জুন দুপুর ১২টায়। মামলায় আসামি করা হয় ওই কিশোরীর প্রতিবেশি তিন যুবক দিপেশ বোনার্জি, বুলবুল গোয়ালা বুলু ও দিপাল তন্তবাইকে। কিশোরীর চা শ্রমিক মায়ের অভিযোগ, দিনে দুপুরে তার কাজে থাকার সুযোগে ওই তিন যুবক ঘরে ঢুকে তার মেয়েকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। ঘটনার ৮ দিনের মাথায় ২৪ জুন চুনারুঘাট থানায় মামলা দায়ের করেন কিশোরীর মা। গ্রেপ্তার করা হয় তিন আসামিকেও। তারা বর্তমানে হবিগঞ্জ কারাগারে আছে।
কিন্তু একাত্তরের কথা’র অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ভিন্ন তথ্য। ঘটনার তারিখ ও সময় সঠিক থাকলেও গল্পটি ভিন্ন। মামলার তিন আসামি একটি অনৈতিক কাজে বাধা দিয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু ঘটনাটিকে পরে ভিন্নভাবে সাজানো হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাঁওতাল ওই কিশোরী হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার মিরপুর গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী। করোনা সংক্রমণের কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সে বাড়িতেই ছিলো। পিতৃহীন ওই কিশোরীর চা শ্রমিক মা কাজে বেরিয়ে যান প্রতিদিন সকালে। বাড়ি ফিরেন সন্ধ্যার দিকে। চলতি বছরের ১৬ জুন মঙ্গলবার, দুপুর ১২টায় দারাগাও চা বাগানের পাকা লাইন এলাকায় ওই কিশোরীর ঘরে প্রবেশ করে একই এলাকার সুবোধ গোয়ালার ছেলে আকাশ গোয়ালা (২০)। কিশোরীর সাথে আকাশ গোয়ালার দীর্ঘ ২ বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। ঘটনার দিন বাড়িতে কেউ ছিলো না। কিছুক্ষণ বসে গল্প করার পর তারা দু’জন অসংযত হয়ে পড়ে।
এদিকে, আকাশ গোয়ালার ওই ঘরে ঢোকা এবং দীর্ঘসময় ধরে বের না হওয়ায় সন্দেহ হয় প্রতিবেশী তিন যুবক দিপেশ বোনার্জি, বুলবুল গোয়ালা ও দিপাল তন্তবাই’র। তারা ঘরের ভেতর উঁকি মেরে ওই কিশোরী ও আকাশ গোয়ালাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পান। তাৎক্ষণিক তারা ঘরে প্রবেশ করে দুজনকে আলাদা করেন এবং তাদের মারপিট করেন। এরপর স্থানীয় ওই তিন যুবক আকাশ গোয়ালাকে রশি দিয়ে বেঁধে রেখে তার পরিবারের লোকজন ও স্থানীয় মুরব্বীদের খবর দেন। এ সময় ওই বাড়ির সামনের রাস্তার বিপরীত পাশে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় বিধু বোনার্জির ছেলে গাড়িচালক প্রদীপ বোনার্জিসহ স্থানীয়রা চিৎকার চেচামেচি শুনে ছুটে আসেন ওই ঘরে। প্রদীপ বোনার্জি আকাশ গোয়ালাকে চিনতে পেরে ঘটনাটি স্থানীয়ভাবে সমাধানের কথা বলে রশি খুলে আকাশকে নিয়ে বাইরে আসেন। এমন সময় আকাশের চাচা বাবুল গোয়ালা ও চাচাতো ভাই সন্তোষ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। চাচা আর ভাইকে দেখতে পেয়ে প্রদীপ বোনার্জির হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় আকাশ গোয়ালা। তার চাচা বাবুল গোয়ালা বিষয়টি দেখে দিবেন বলে আশ্বাস দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এভাবেই কেটে যায় ৭ দিন। কিন্তু স্থানীয়ভাবে মিমাংসা হয়নি। এরই মধ্যে খবর রটে চুনারুঘাটের চা বাগানে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে এক সাঁওতাল স্কুলছাত্রী। ধর্ষণকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয় অনৈতিক কাজে বাধা প্রদান করা তিন যুবক দিপেশ, বুলবুল ও দিপালের নাম। মামলা না নেওয়ার জন্য দোষারোপ করা হয় পুলিশকেও। অথচ পুলিশ কিছুই জানে না। এমনকি মেয়েটির পরিবারের তরফ থেকেও অভিযোগ দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে একটি চিঠি আসে চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে। চতুর্দিক থেকে চাপে পড়ে প্রশাসনও।
ঘটনার ৭ দিন পর ২৩ জুন থানায় ধর্ষণের অভিযোগ এনে দিপেশ, বুলবুল ও দিপালের নাম উল্লেখ করে একটি অভিযোগ দায়ের করেন দায়ের করেন ওই কিশোরীর মা। মামলায় স্বাক্ষী হিসেবে রাখা হয় ওই কিশোরী, তার প্রেমিক আকাশ গোয়ালা এবং স্থানীয় গাড়ি চালক প্রদীপ বোনার্জিকে।
এদিকে, মামলা দায়েরের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে পড়েন তিন যুবক। তাদের ভাষ্যমতে, ‘আমরা শুধু একটি অনৈতিক কাজে বাধা দিয়েছিলাম। এর প্রতিদান হিসেবে আমরা পেলাম ধর্ষকের তকমা। অথচ মূল ধর্ষক এই মামলার স্বাক্ষী’।
২৩ জুন বিকেলে ওসি শেখ নাজমুল হকের নির্দেশে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন চুনারুঘাট থানার এসআই ভূপেন চন্দ্র বর্মণ। তিন যুবকের পরিবার তাদের ছেলেরা নির্দোষ বলে দাবী করলে এসআই ভূপেন তাদেরকে বলেন, ওসি স্যার বলেছেন সব স্বাক্ষীপ্রমাণ নিয়ে থানায় আসতে। ওইদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় সাটিয়াজুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রশিদ মাস্টার, স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য মাহমুদ মিয়াসহ তিন যুবক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা থানায় উপস্থিত হন। এসময় তাদের সাথে ছিলেন ধনঞ্জয় সাঁওতাল, যুগেশ সাঁওতাল, চন্দ্র সাঁওতাল, দোলন সাঁওতাল। এই অসস্থায় দিপেশ, দিপাল ও বুলবুলকে আটক রেখে বাকিদের থানা থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন থানার ওসি শেখ নাজমুল হক। আলোচিত ধর্ষণের ঘটনায় তিন যুবক আটকের খবর দ্রæত ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। পরদিন ২৪ জুন মামলা রেকর্ড করে কারাগারে পাঠানো হয় দিপাল, বুলবুল ও দিপেশকে। এরপর ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আটক করা হয় ওই মামলার স্বাক্ষী, কিশোরীর প্রেমিক ও ঘটনার মূল নায়ক আকাশ গোয়ালাকে।
আদালতে সোপর্দ করার পর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে সব সত্য কথা স্বীকার করে আকাশ। তার সাথে ওই কিশোরীর প্রেমের সম্পর্ক এবং ১৬ জুন সে ও ওই কিশোরীকে আপত্তিকর অবস্থায় আটক এবং মারধর করা হয় বলে জানায় আকাশ গোয়ালা। একই জবানবন্দি প্রদান করে ‘কথিত’ ধর্ষণের শিকার ওই কিশোরীও। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে তারা একে অপরকে বিয়ে করার ইচ্ছেও প্রকাশ করে।
কথা হয় মামলার স্বাক্ষী প্রদীপ বোনার্জির সাথে। তিনি একাত্তরের কথাকে জানান, ‘১৬ জুন আমি ঘটনাস্থল সংলগ্ন মন্দিরের পাশে আমার বাসার সামনে ছিলাম। চিৎকার শুনে আমি দৌড়ে ওই কিশোরীর ঘরে প্রবেশ করে দেখতে পাই আকাশ গোয়ালা দড়িতে বাধা। কিশোরী একটু দূরে দাড়িয়ে কাঁদছে। আকাশকে অনৈতিক কাজে হাতেনাতে ধরে হালকা মারধর করেছিলো দিপাল, বুলবুল ও দিপেশ। তখন আমি আকাশকে চিনতে পেরে রশি খুলে বাইরে নিয়ে আসি। এমন সময় তার চাচা ও চাচাতো ভাই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। তাদের দেখে আমার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় আকাশ গোয়ালা। এরপর আকাশের চাচা বাবুল বলেছিলো ঘটনাটি স্থানীয়ভাবে মিমাংসা করা হবে। কিন্তু সপ্তাহখানেক পর জানতে পারি তিন যুবককে আসামি এবং আমাকে স্বাক্ষী করে মামলা দায়ের করেছেন ওই কিশোরীর মা। মামলার এজাহারে সব মিথ্যে এবং গাঁজাখুরি গল্প লিখা হয়েছে। বাস্তবিক অর্থে ওই কিশোরী এবং আকাশ গোয়ালার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো বলে আমরা জানতে পারি।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদ মাস্টার, ওয়ার্ড সদস্য মাহমুদ আলী, সাবেক সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড সদস্য শান্তি রাণী আচার্য্য এবং সাবেক চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আবদাল রহমানও একই তথ্য জানান। এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় ধনঞ্জয় সাঁওতাল, যুগেশ সাঁওতাল, চন্দ্র সাঁওতাল, দোলন সাঁওতাল ধর্ষণ নাটক সাজাতে কলকাঠি নেড়েছেন।
চুনারুঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ নাজমুল হক বলেন, ঘটনায় এজাহারভুক্ত ৩ আসামির পাশাপাশি ঘটনায় জড়িত থাকায় মামলার এক স্বাক্ষীকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন। তদন্তের স্বার্থে এরচেয়ে বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।
সূত্রঃ দৈনিক একাত্তরের কথা
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি