সব
সিলেটের ওসমানীনগরে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ফাইজার মৃত্যু নিয়ে রহস্যের জট খুলছে না। বুধবার বিকালে ময়নাতদন্ত শেষে উপজেলার তাজপুর ইউনিয়নের রঙ্গিয়া গ্রামের মামার বাড়িতে ফাইজার লাশ নিয়ে আসা হলে বিদ্যালয়ের সহপাঠি, শিক্ষক ও স্বজনদের কান্না ও আহাজারিতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
স্বজনসহ সবার দাবি, এই ছোট শিশুটি কোনোভাবেই আত্মহত্যা করতে পারে না। এছাড়া, তার গায়ে একাধিক স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। থানা পুলিশ ‘ঘাতকদের ছেড়ে দিয়ে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে সাক্ষর নিয়ে’ অপমৃত্যুর মামলা রুজু করেছে। তাদের দাবি, ফাইজাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এরপর হত্যা করে লাশ ঝুঁলিয়ে রাখা হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ফাইজাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তবে ভিন্ন কথাই বলছে পুলিশ।
সার্বিক বিষয়ে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন খাসদরগাহ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুনন্দন কমার দাসসহ উপস্থিত লোকজন। এসময় ফাইজা হত্যার সাথে জড়িতদের বিচার চেয়ে খাসদরগাহ বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ সমাবেশ করতে দেখা গেছে স্থানীয়দের।
বুধবার সন্ধ্যায় ফাইজার নানার বাড়িতে প্রথম জানাযার নামাজের পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় উপজেলার ব্রাহ্মণগ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। ফাইজা বেগম গ্রামের তুরণ মিয়া ও লায়লা বেগমের মেয়ে।
এদিকে, দশ বছরের শিশু ফাইজার লাশ উদ্ধারের তিনদিন অতিবাহিত হলেও এটি হত্যা না আত্মহত্যা তা নিয়ে রয়ে গেছে ধূম্রজাল। থানা পুলিশ নিহতের পরিবারের অভিযোগ আমলে না নিয়ে শিশুর মায়ের স্বাক্ষর নিয়ে তড়িগড়ি করে থানায় অপমৃত্যুর মামলা রুজু করেছে বলে অভিযোগ করেছেন ফাইজার মামা আবুল কালামসহ অন্যান্য স্বজনরা।
তাদের দাবি, পরিকল্পিতভাবে শিশুটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ ঝুঁলিয়ে রাখা হয়েছিল। এটি আত্মহত্যা নয়। তারা হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার জন্য থানা পুলিশের কাছে মিনতি করেছেন। কিন্তু পুলিশ ময়নাতদন্তের দোহাই দিয়ে ‘ঘাতকদের ছেড়ে দিয়ে হত্যা মামলার অভিযোগ আড়াল করে’ ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই ‘কৌশলে অপমৃত্যুর মামলা রুজু করেছে’।
তবে, এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ওসমানীনগর সার্কেল) রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, সার্বিক বিষয়ে তিনি অবগত রয়েছেন, পারিবারিক কলহের জের ধরে শিশুটি নিজ থেকে আত্নহত্যা করে মারা গেছে। প্রাথমিক তদন্তে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় থানায় অপমৃত্যুর মামলা রুজু করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রির্পোটে পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা যায়, গত সোমবার তুরণ মিয়া কাজে ছিলেন। তখন লায়লা বেগম ফাইজাকে ঘরে রেখে ছোট ছেলেকে নিয়ে বাজারে যান। সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাড়িতে ফিরে বসতঘরের বাঁশের তীরের সাথে মেয়েকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে চিৎকার শুরু করেন লায়লা। তখন আশপাশে থাকা কয়েকজন ছুটে এসে ঘরের লাইট বন্ধ করে দেয়। তখন লায়লা লাইট বন্ধের কারণ জানতে চান। কিন্তু তারা জবাব না দিয়ে দ্রুত ফাইজাকে নিয়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
খবর পেয়ে সোমবার রাতে ওসমানীনগর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ফাইজার তিন চাচাতো ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে। মঙ্গলবার এ বিষয়ে অপমৃত্যুর মামলা রুজু করে তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ।
ফাইজার লায়লা বেগম বলেন, ‘আমার মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করে ঘাতকরা লাশ ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে রেখে গা ঢাকা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে ওই সময়েই আমি বাড়িতে এসে পড়ায় ঘাতকরা দ্রুত লাশ নামিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সার্বিক বিষয়ে থানা পুলিশকে জানানোর পরও পুলিশ ঘটনার রাতে ওসমানী হাসপাতালে আসার প্রয়োজন মনে না করে মঙ্গলবার সকালে হাসপাতালে এসেছিল। থানা পুলিশ হাসপাতালে দেরিতে আসায় ময়ন্ততদন্ত সম্পন্ন করতে বেশি সময় লেগেছে।’
তিনি বলেন, ‘সোমবার রাতেই থানা পুলিশ তাৎক্ষণিক আমাদের বাড়িতে গিয়ে আমার ভাসুরদের তিন পুত্রকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। কিন্তুু মঙ্গলবার আটকৃতদের অভিযুক্ত করে থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরও থানা পুলিশ আমার অভিযোগটি আড়াল করে হুমকির মাধ্যমে আমার স্বাক্ষর নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়। পুলিশ পারিবারিক কলহের কাল্পনিক ঘটনা বানিয়ে আমার ছোট শিশু ফাইজা আত্মহত্যা করেছে, এমনটা বলে বেড়াচ্ছে।’
তাজপুর স্থানীয় ইউপি সদস্য নেয়া বিবি বলেন, ‘আমি একাধিকবারের জনপ্রতিনিধি হিসাবে এসব বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি খুব কাছ থেকে শিশু ফাইজার লাশটি দেখেছি। আমার দেখামতে, তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।’
নিহত ফাইজার লাশের গোসলের কাজে নিয়োজিত থাকা উপজেলা আনছার ভিডিপির সহকারী কমান্ডার তাছলিমা বেগম ও নিহতের নিকটাত্মীয় আছারুন বিবি বলেন, ‘আমারা লাশের গোসল করানোর সময় একাধিক স্থানে আঘাতের চিহ্ন ও মুখমন্ডলসহ শরীরের একাধিক অংশে কামড় ও নখের আচড় দেখেছি। তার গোপনাঙ্গও ক্ষতবিক্ষত রয়েছে। তাকে যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এটা লাশের গোসলের সময় নিশ্চিত হয়েছি।’
ওসমানীনগর থানার ওসির দায়িত্বে থাকা অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) মাকসুদুল আমিন বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাৎক্ষণিক কয়েকজনকে থানায় নিয়ে আসা হয়েছিল। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর অপমৃত্যুর মামলা রুজুর পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি