সব
যে বিকারগ্রস্ত মানসিকতা নিয়ে আমাদেরই একদল মানুষ দেশের বুকে বিচরণ করছে তা এদেশের জন্য, এদেশের আপামর জনসাধারণের জন্য, বাঙালি জাতিসত্ত্বার জন্য সর্বোপরী আগামী প্রজন্মের জন্য সেটি এক ভয়াবহ অভিশাপ বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন, এই ক্ষুদ্র অংশটির জন্য একটা পর্যায়ে চরম অবজ্ঞা আর অবহেলার শিকার হবে গোটা প্রজন্ম। আর সেটা সুনিশ্চিতভাবেই এদেশের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি। আমাদের বিবেকবোধ এতটাই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে সুচিন্তন আর সুবচনের সামর্থ্যই যেন নিঃশেষিত। কি বলছি, কি ভাবছি, কি করছি আর কি হচ্ছি; সে বিষয়ে একেবারে অসচেতন। নানা ক্ষেত্রে আমাদের মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দ্বারা একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিশেষ করে প্রগতিশীল একটি জাতির বর্তমান প্রজন্ম হিসেবে আমাদের অযোগ্যতা ক্রমেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। যার আরো একটি উদাহরণ সামনে এলো প্রয়াত নেতা মোহাম্মদ নাসিম প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে। রাষ্ট্র, সরকার, বিধান, রীতি এমন সকল ক্ষেত্রেই সমালোচনা আর গুজব মাখা একটা বিকারগ্রস্ত মানসিকতার প্রকাশ দিচ্ছি আমরা। আজকের বিশ্বে নিজেদের অবস্থানটুকু একটু অনুধাবন করাটা বোধ করি খুব জরুরি হয়ে পড়েছে আমাদের জন্য।
বিশ্বের এমন খুব কম দেশ আছে যেখানে সরকার বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি জনগণের নূন্যতম অসন্তুষ্টি নেই। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যন্ত্রের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভও হয়। আর ঐতিহ্যগতভাবেই এ সকল কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয় দেশের তারুণ্য। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে যে বর্ণবিরোধী আন্দোলন চলছে সেখানেও এই একই সত্য প্রতিফলিত। নিজেদের দাবি উত্থাপন, প্রতিবাদ প্রকাশ বা সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোথাও সেদেশের তরুণরা অশ্লীল, অশালীন বা অশ্রাব্য কোনো উক্তি ব্যবহার করে ডোনাল্ড ট্রাম্প বা সরকার ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এমন একটি উদাহরণও কেউ দেখাতে পারবেন না। শুধু তাই নয়, নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশের কোনো অংশে দেশ, জাতি বা সরকারের প্রতি কোনো প্রকার বাজে মন্তব্যও তাদের নেই। ঠিক যার উল্টটা করা আমরা নিজেদের স্বভাবে পরিণত করেছি।
একটি রাষ্ট্রের জনগণ তার সরকারের কোনো পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে কতটা আদর্শ পন্থা অবলম্বন করতে পারে এবং বিশিষ্টজনদের প্রতি কিরূপ অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে তা বুঝে নিতে সাম্প্রতিক সময়ের দুটো আলোচিত ঘটনার প্রসঙ্গ সংক্ষেপে আলোচনা করা যেতে পারে। যার প্রথমটি হচ্ছে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট বিরোধী আন্দোলন ও অপরটি ফ্রান্সের ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন। যার দুটোই গড়ে উঠেছিল দেশ দুটির তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে।
ব্রিটেনের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের প্রাককালে বেশ জোরালো হয়ে ওঠে ব্রেক্সিট বিরোধীদের প্রতিবাদ। সে সময় থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাড়ানোর পর ক্ষমতাসীন টরে পার্টির নেতৃত্ব নেন দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এরপরেই আসন্ন নির্বাচনে জয়লাভ মাত্র ব্রেক্সিট কার্যকরের অটল সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন তিনি।৷ এতে করে ব্রেক্সিট বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে ব্রিটেন। হাজারো ফ্যাস্টুন, ব্যানার আর দেয়াল লিখনে ফুটে ওঠে ব্রেক্সিট বিরোধী স্লোগান। কিন্তু সেখানে থেরেসা মে বা বরিস জনসনের বিরুদ্ধে একটি বাজে মন্তব্য করা হয়েছে তেমন কিছু মনে পড়ে না।
ঠিক সেই সময় দেশটি সফরে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে তিনি ব্রেক্সিট ইস্যু সমাধানে সহযোগিতার কথা বলতেই ব্রিটিশ নাগরিকদের চরম প্রতিবাদের মুখে পড়েন। ট্রাম্পের ব্যঙ্গ চিত্র ও প্রতিকৃতি গড়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো হয়। একই সঙ্গে তাকে দ্রুত ব্রিটেন ত্যাগ করার দাবিও তোলা হয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কোনো রকমে মান নিয়ে ব্রিটেন ত্যাগ করেন ট্রাম্প। ব্রিটেনের মানুষ তখন একটাই কথা তুলে ধরেছিলো তাদের প্রতিবাদি স্লোগানে, ব্রেক্সিট ব্রিটেনের নিজেস্ব ব্যাপার৷ সে হোক বা না হোক, এ নিয়ে বাইরের কারো কথা বলার অধিকার নেই। সবিশেষ সেই নির্বাচনে কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে বরিসের নেতৃত্বাধীন টরে পার্টিই।
দ্বিতীয় ঘটনাটির কথা বলতে গেলে আরেকটু পেছনে যেতে হবে, ফ্রান্সের বুকে চলমান সেই সহিংস ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। তাহলে দেশপ্রেম ও জাতিসত্ত্বার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের এবং রাষ্ট্রের বিশিষ্টজনদের প্রতি অভিব্যক্তি প্রকাশের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত এখানেও চোখে পড়বে। ফ্রান্সের বুকে যখন জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের বাজার চড়া তখন এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। ইয়েলো ভেস্ট নামক একটি সংগঠন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ন্যায্য দাবির পক্ষে জনমত গড়ে তোলে এবং এক পর্যায়ে রাস্তায় নেমে আসে। প্রতিবাদের তীব্রতা এমনই ছিলো যে, প্যারিসসহ ফ্রান্সের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর লকডাউন করে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। বিক্ষোভের মুখে সে সময় রীতিমত কেঁপে ওঠে ইমানুয়েল ম্যাখোঁ সরকার। এমনই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ আরো বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের নেতারা বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ফ্রান্স সরকারের সমালোচনায় সরব হয়ে ওঠেন। কিন্তু এর জেরে বিক্ষোভকারীদের তীব্র সমালোচনার মুখে রীতিমত অপমানিত হতে হয় তাদের। ফ্রান্সের মানুষ এক কথায় জানিয়ে দেয়, এটা তাদের আভ্যন্তরিন বিষয়। ফ্রান্সের জনগণ তার সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করছে। বহিরাগত কারো নাক গলানোর কোনো অধিকার নেই! আর তাদের সরকার প্রধান বা অন্য কারো বিরুদ্ধে বহিরাগতদের মন্তব্য মেনে নেয়া হবে।
এবার আসা যাক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। সচরাচর এমন সব ক্ষেত্রে আমরা কি করি তা আমাদের বেশ জানা আছে। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সরকার এমন কি দেশদ্রোহীদের সাজা প্রদানের ক্ষেত্রেও প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করে যে কেউ, আমরা ঔপনিবেশিক দাসত্বের স্বভাব বদলাতে পারিনি, তাই হুজুর হুজুর করি। পরের গুণ গাই কিন্তু নিজেদের আত্মসম্মান জলাঞ্জলী দেই সহাস্যে। নির্বাচনের মত রাষ্ট্র পরিচালনা ও সরকার গঠনের সংগে সম্পৃক্ত স্পর্শকাতর ইস্যুতে পরের কথায় নাচন-কুদন চলে আমাদের। কোথাকার কোন বার্টলসম্যান স্টিফটুং প্রতিবেদিন প্রকাশ করে সরকারের বিরুদ্ধে আর আমরা সেটার ভিত্তিতে নিজেদের সরকারকে ডাকি ‘স্বৈরাচার’। অথচ নূন্যতম সময়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের খাতায় নাম লেখানোর সামর্থ্য জুটিয়ে দিয়েও সমালোচনাই জোটে সরকারের।সরকারের সঙ্গে আমাদের এই অবাঞ্চিত তিক্ততা রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর এমনিই দুর্বলতা জানান দিয়েছে যে, মিয়ানমারের মত রাষ্ট্রও তাচ্ছিল্য করে কথা বলেছে সময়ে, মাথার ওপর সামরিক হেলিকপ্টারও উড়িয়েছে।
চলমান করোনা মহামারির মাঝে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও বিপর্যস্ত। দুঃখজনকভাবে বিগত মাত্র কয়েকদিনে করোনা সংক্রমণ ছাড়াও নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রবীণ নেতৃবৃন্দ। যাদের অনেকেই আমাদের চিরদিনের জন্যে ছেড়ে চলে গেছেন। সর্বশেষ এই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণের দুজন বর্ষীয়ান নেতা চলে গেলেন। যাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের সুদীর্ঘ দিনের বিশ্বস্ত সৈনিক, রাজপথের লড়াকু নেতা, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। দেশের সকল গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছেয়ে গেছে শোকের ছায়ায়। সংগ্রামী জীবনের অন্যতম বিশ্বস্ত বন্ধু হারিয়ে শোকে মুহ্যমান স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী। দলীয় নেতাকর্মীতো বটেই, মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুতে আবেগ আপ্লুত ভাষায় শোক বার্তা জানিয়েছেন বিএনপিসহ সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং সর্বস্তরের মানুষ।
তবে অত্যন্ত লজ্জার বিষয় হচ্ছে, দেশের একদল মানুষ, বিশেষ করে কতিপয় তরুণ- বর্ষীয়ান এই রাজনৈতিক নেতার অসুস্থতা ও প্রয়ান প্রসঙ্গে এত বিকৃত এবং ঘৃন্য মন্তব্য প্রকাশ করেছেন যা রীতিমত বিস্ময়কর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে, কখনো বা এ বিষয়ে কারো পোস্টের মন্তব্য হিসেবে, আবার কখনো সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের প্রেক্ষিতে তাদের এসকল অপ্রত্যাশিত মন্তব্য দেশের সর্বস্তরের মানুষের নজরে এসেছে। কেউ বলছেন, স্বাস্থ্যখাতে একসময় চরম দুর্নীতি চালিয়েছেন প্রয়াত এই সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী, কেউ আবার বলছেন উনি দেশের স্বাস্থ্য খাতের সর্বনাশ করেছেন। তাঁরা আমলে দুর্নীতি হয়েছে তার জেরে নাকি এ সময় করোনায় ভুগছে দেশ। কি অদ্ভুত তথ্য! অথচ যারা এই জুজুর গল্প শোনাচ্ছেন তাদের কেউ হয়তো জানেনই না কি অবান্তর মিথ্যাচার তারা চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সাবেক এই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আমলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে যে অর্জন এসেছে তা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বিখ্যাত ল্যানসেট জার্নালে (ভলিউম ৩৮২, ইস্যু ৯৯০৬-৯৯১০) তৎকালিন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নের প্রেক্ষিতে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও তার বাস্তবায়নের বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। শুধু তাই নয় এই অভূতপূর্ব অর্জনের প্রক্রিয়াকে একট অনুসরনীয় মাইলফলক বলেও অভিহিত করা হয়েছে। হাজার সীমাবদ্ধতার মাঝেও কি করে বাংলাদেশ সে অর্জন সম্ভব করেছিলো তা নিয়ে রীতিমত বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অর্মত্য সেন। তাহলে দুর্নীতির প্রাপ্তি যদি এই হয়, তবে তো বলবো- অবান্তর মিথ্যাচারীতায় লোক দেখানো নিষ্ঠা আর নীতির অবাস্তব তত্ত্বের চেয়ে এই দুর্নীতিই উত্তম।
এতো গেল এই বিশেষ গোষ্ঠির বিকৃত মানসিকতার খুব সামান্য একটি অংশ। কারো কারো মন্তব্যের ভাষা এবং অভিব্যক্তি এতটাই লজ্জাস্কর যে, সেগুলো দেখলে যে কেউ বুঝে নিতে পারবেন যে, পারিবারিক শিক্ষা বা তেমন শিক্ষা অর্জনের পরিবেশ তাদের পরিবার নিশ্চিত করতে পারেননি। তাদের সনদবদ্ধ যে অর্জিত শিক্ষাটুকু আছে তাও যে কেবল পেটের তাগিদে নেয়া এবং মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে অক্ষম ও অর্জিত বিদ্যার অবমাননা, সেটাও নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
শুধু এই একটি ক্ষেত্রেই নয়, দেশের এই একদল মানুষ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে নীতি, আদর্শ, মানবতা, বোধ, বিবেক বা নৈতিকতার নুন্যতম চর্চা কখনো না করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল আদর্শ আর নৈতিকতার বেশ লম্বা চওড়া বক্তব্য তারা লিখতে পটু। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এমন যাদের ফেসবুক-টুইটারের দেয়াল ভরা নীতি আদর্শের বাণী, মনীষীদের ভাবগম্ভীর উক্তি আর শাস্ত্রের বড় বড় বুলি উপচে পড়ে, একটু যাচাই করলেই দেখা যায়, তাদের অধিকাংশেরই ওয়েব দুনিয়ার অন্ধকার জগতে বিচরণ সবচেয়ে বেশি।৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মত শক্তিশালী একটি প্ল্যাটফর্ম কাজে লাগিয়ে তারা ইতিবাচক কোনো কাজ তো করতেই পারেন না বরং সচেতন তরুণ সমাজের নানা পদক্ষেপকে বিতর্কিত ও বিনষ্ট করেন নিজেদের এমনতর বিকৃত মানসিকতার অভিশাপে।
রাষ্ট্র বা সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে রাষ্ট্রের নাগরিকের যে সম্পর্ক তা ঠিক একটি পরিবারের মত। সেখানে ভালোবাসা-বিবাদ, সমঝোতা-বৈরীতা, মতৈক্য-মতভেদ এমন সবকিছুই থাকে। কিন্তু তাই বলে পরিবারের একজন সদস্য অন্য সদস্যদের অপমান অপদস্ত করবে, তৃতীয়পক্ষের হস্তক্ষেপে সমর্থন দেবে, পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হলে তা প্রতিহিত না করে বিভীষণের মত আচরণ করবে, স্বজনের মৃত্যুকালে তার ব্যাপারে উদ্ভট-বিকৃত মন্তব্য করবে; সেটা কখনোই মেনে নেয়া যায় না। আর এমন মানুষগুলো পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে কোনো প্রকার সমীহ পাওয়ারও যোগ্যতা রাখে না। বরং পারিবারিক বন্ধন, আদর্শ, ঐতিহ্য ও রীতি-নীতি বজায় রাখতে এবং অন্যান্য সদস্যদের মাঝে পরিবারের প্রতি সম্মান অটুট রাখতে এমন ঔচ্ছন্যে যাওয়া মানুষগুলোকে ত্যাজ্য করা আবশ্যক। নইলে এক সময় পুরো পরিবারকেই সমাজ ছাড়া হতে হবে।
জনগণই রাষ্ট্রের শক্তি। সাম্প্রতিক বিশ্বের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বলা যায় তরুণদের কাছে রাষ্ট্রের প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি। তারুণ্যই একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কর্ণধার। সময়ে সময়ে আমরা আজকের এই প্রগতিশীল বাংলাদেশের আলোকবর্তিকাধারী যে মাশরাফী বিন মর্তুজা, শেখ সারহান নাসের তন্ময় বা ব্যারিস্টার সুমনের মত তরুণদের ফ্যান ক্লাবে গড়াগড়ি খাই। সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য দাপিয়ে বেড়ানো টিউলিপের অর্জনে বিমোহিত হই। অথবা মাসুম খানের মত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনকারী কোনো বাংলাদেশি তরুণ ভাষাতাত্ত্বীক ও ইতিহাস গবেষকের হাতে ম্যাক্স মুলারের বিকৃত ইতিহাস তত্ত্বের পতন আর বাংলার প্রাচীন সভ্যতা অর্জনের অবদান সম্পর্কে জেনে রোমাঞ্চিত হই; তাদের অনুসরনের প্রচেষ্টাও করতে হবে৷আমাদের মানসিকতার বিকাশ ঘটাতে হবে, অনুসারী হতে হবে তারুণ্যের সেই ধ্বজাধারীদের। নিজেদের সরে আসতে হবে বিভ্রান্তি ও অসত্যের পথ থেকে, অন্যদের সুপথে আনত হবে। সেটা যদি সম্ভব হয় তাহলেই আমরা জানতে পারবো, অনুধাবন করতে পারবো যে- জাতীয় নেতা শহীদ মনসুর আলীর সুযোগ্য উত্তরসূরী, বাংলাদেশের কিংবদন্তী তুল্য বর্ষীয়ান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রয়াত নেতা মোহাম্মদ নাসিমের মত যে মানুষটিকে নিয়ে অপ্রত্যাশিত, অবাঞ্চিত মন্তব্যে আজ তার বিদেহি আত্মাকে মর্মপীড়া দিচ্ছি; তিনিও এককালে একটি প্রজন্মের তরে উজ্জীবিত তারুণ্যের আদর্শ হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। একজন প্রতিভাবান তরুণ ছাত্রনেতা থেকেই সময়ের সঙ্গে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন দেশবরেণ্য শক্তিমান রাজনৈতিক ব্যক্তিত মোহাম্মদ নাসিম। স্বরাষ্ট্র থেকে স্বাস্থ্য- প্রতিটি ক্ষেত্রে সফল একজন মন্ত্রী, মোহাম্মদ নাসিম।
আজ এই দেশপ্রেমিক নেতাকে হারিয়েছে জাতি। সময় বয়ে যাবে, নেতৃত্বের পালাবদল আসবে কিন্তু এমন একজন মোহাম্মদ নাসিমকে হয়তো কেবল ইতিহাসের পাতাতেই খুঁজে পাওয়া যাবে। আর হয়তো এমন কেউ আসবে না, আমরা পাওয়ার যোগ্য না। আমরা শোকাহত, আমরা তাকে হারিয়ে ফেলেছি।আমরা প্রজন্ম হিসেবে লজ্জিত, তার বিদেহি আত্মাকে বিদায় বেলায় মর্মাহত করেছি। বিবেকের এই দংশনেই আমৃত্যু যেন এক চিত্তদাহ সব আর কবির মত কব-
“কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-, গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।”
• লেখক: সহ-সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি