সব
আমলাতন্ত্রের মারপ্যাঁচে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। এত দিন বিচ্ছিন্নভাবে বিষয়টি নজরে এলেও করোনায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমলাদের অতিরিক্ত খবরদারির কারণে দেশের করোনা চিকিৎসা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এমনকি জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে চাপিয়ে দেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তে করোনা চিকিৎসাও ব্যাহত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ কমিটিসহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল কমিটিকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নেয়ায় আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে। এ কাজগুলো করেছে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ কতিপয় স্বার্থান্বেষী কর্মকর্তা। তারা এতই দাপুটে যে মন্ত্রীকেও পাশ কাটিয়ে একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যাতে মন্ত্রীকে হতে হয়েছে বিব্রত। বলতে হয়েছে তিনি এসব সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু জানেন না। তাকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এমন বক্তব্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিডিয়াতে বারবার দিয়েছেন। মন্ত্রী-সচিব দ্বন্দ্বে স্বাস্থ্য খাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। সমন্বয়হীনতা এখন গোটা স্বাস্থ্য খাতজুড়ে। নতুন স্বাস্থ্য সচিব দায়িত্ব গ্রহণের পরে এ সমন্বয়হীনতা আরও বেড়েছে। মন্ত্রীকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে একতরফা।
স্বাস্থ্য খাতের সর্বক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের একক আধিপত্য বিস্তারের অপপ্রয়াস চলছে। এতে ভেঙে পড়ছে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্তৃত্ব গ্রহণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন সচিবালয়ভিত্তিক আমলারা। করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত সরকারি ডাক্তার নার্সদের জন্য হোটেলে থাকার ব্যবস্থা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা না করেই বাতিল করা হয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বন্ধ করে দেয়া হয় করোনার নিয়মিত বুলেটিন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বুলেটিন বন্ধ করায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন এতে গুজব ছড়াতে পারে। তিনি সপ্তাহে অন্ততপক্ষে দুদিন বুলেটিন প্রচারের সুপারিশ করেন। আরও বড় বিষয় হলো মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যমে কোনো কিছু বলতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নিষেধ করা হয়েছে, যা অধিদপ্তরের ওপর হস্তক্ষেপের শামিল। সবসময় স্বাস্থ্য সম্পার্কিত বিষয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
এবার সেই ক্ষমতাও কেড়ে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ কিছু আমলা স্বাস্থ্যের পুরো ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছেন। করোনাকালে চিকিৎসাসেবা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে চিকিৎসক নার্স ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। প্রদত্ত সুবিধা প্রত্যাহারের ফলে বিএমএ ও স্বাচিপ ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, এই দুঃসময়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে একশ্রেণির আমলা বিভিন্ন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে নতুন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিছুদিন পর আবার বলা হচ্ছে, তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক। স্বাস্থ্যে অনেক কমিটি থাকলেও তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। এসব কমিটির কাজে গতি আনার পরিবর্তে গত ২৬ জুলাই হাসপাতালের অনিয়ম তদারকিতে অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেননা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সমন্বয়ে হাসপাতালগুলোর দেখভালের জন্য একটি ভিজিলেনস টিম আছে। এর সভাপতি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। আর সদস্যসচিব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক। তাদের কাজ নিয়মিত বিভিন্ন হাসপাতালে যাবে, ডাক্তারদের উপস্থিতি ও সেবা মনিটরিং করা। কিন্তু বাস্তবে এ কমিটির কার্যক্রম চোখে পড়ে না। উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কমিটি আছে। পদাধিকার পদে এই কমিটির সভাপতি স্থানীয় সংসদ সদস্য।
এই কমিটি নিয়মিত মিটিং করে সুপারিশগুলো সিভিল সার্জনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা। জেলা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কমিটি আছে জেলা পর্যায়ে। এই কমিটির প্রধানও এমপিরা। বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ও আছে। বেসরকারি ক্লিনিক দেখভাল করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কমিটি আছে। কিন্তু কোনো কমিটিই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এতগুলো কমিটি থাকতে টাস্কফোর্স গঠন করার প্রয়োজন কী? যেসব কমিটি আছে সেগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে নতুন কোনো কমিটির প্রয়োজন নেই। এত কমিটি থাকলেও এসব কমিটির কোনো মিটিং হয় না। স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের ডাকা হয় না। সবই আমলারা বসে নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা কমিটির পর কমিটি করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। কমিটি কোনো কার্যক্রম থাকে না। এ অবস্থায় টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্তে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মালিকরাও ক্ষুব্ধ।
তারা বলেছেন, এত কমিটি থাকতে আরেকটি কমিটির প্রয়োজন নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করলে তারা হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন বলে জানিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক যখন তখন বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অভিযান পরিচালনা করতে সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো হাসপাতালের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার উদ্যোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে ইনকোয়ারি করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ অনুমতি ছাড়া হাসপাতালের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অভিযান চালাতে পারবে না বলে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, একে গুরুত্বপূর্ণ এবং ভালো সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেন।
তিনি এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আমাদের বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার একটি ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল। এ প্রজ্ঞাপনের ফলে তা প্রশমিত হবে বলে আশা করি। কিন্তু খুশি হতে পারেননি স্বাস্থ্য সাচিব। যেহেতু মন্ত্রীর উদ্যোগে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেহেতু স্বাস্থ্য সচিব বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারছেন না বলে তার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে প্রতীয়মান হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেখানে বলেছেন, হাসপাতলে অভিযান কেন? ইনকোয়ারি হতে পারে। অভিযান তো হয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। এ নোটিশ জারির দুদিন পরেই স্বাস্থ্য সচিব এক সভা ডেকে মন্ত্রীকেই বস্তুতপক্ষে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। সচিবের একক কর্তৃত্ব বজায় রাখার অপতৎপরতার ফলে মন্ত্রণালয়ের কাজেকর্মে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।
সূত্র- বাংলাদেশ জার্নাল
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি